প্রতীকী ছবি।
ছয়-সাত বছরের আগে-পরে হবে। ষোলো বছর বয়সি এক কিশোরকে তানজানিয়ার জন্মভূমি ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়েছিল। কারণ, তখন তাঁর জন্মভূমি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। তারই বছর সাতেক পরে ভূখণ্ডের অন্যদিকে একদল লোককেও জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তার কারণ দেশভাগের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। কাঁটাতার, কত নদী, খাল-বিল পেরিয়ে সেই লোকগুলি চলে এসেছিলেন জলপাইগুড়ির তিস্তার পাড়ে। তানজানিয়ার সেই ষোলো বছররে কিশোরটি পরবর্তী কালে ইংরেজি ভাষায় তাঁরই মতো ছিন্নমূল মানুষদের কথা লিখে চলেছেন। ছিন্নমূল হয়ে আসা তিস্তাপাড়ের সেই লোকেরা নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা করতে পত্তন করেছিলেন দুর্গাপুজো। তানজানিয়ার সেই কিশোরটির বয়স এখন ৭৩ বছর। তিনি আব্দুলরাজ়াক গুরনা। উদ্বাস্তুদের কথা লিখতে লিখতে তিনি এ বছর সাহিত্যে নোবল পুরস্কার পেলেন। এবং এ বছরই তিস্তাপাড়ের সেই উদ্বাস্তুদের শুরু করা দুর্গাপুজো ৫০ বছরের দোরগোড়ায়।
জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তা নদীতে বাঁধ রয়েছে। বাঁধের দুই দিকে চর। দুই পাড়েই বসতি। বাঁধের উপরে বাঁশ পুঁতে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। সাদামাঠা মণ্ডপ, সাধারণ প্রতিমা, ছিমছাম পরিবেশ। কিন্তু এই পুজো ঘিরে গল্পের চলাফেরা নদীর মতোই। দেশভাগের সময় একদল লোক কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে প্রথমে চলে আসেন নদিয়ায়। কিন্তু সেখানে নাকি মন টেকেনি সদ্য দেশছাড়া হওয়া মানুষগুলির। তাঁরা চলে আসেন জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া তিস্তাপাড়ে। তখন তিস্তা সবে জলপাইগুড়ির শহরের পাশ দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর ফেলতে শুরু করেছে। সেই চরই পছন্দ হয়ে যায় উদ্বাস্তু বাসিন্দাদের। বসতি তৈরির দিনকয়েক পর থেকেই শুরু হয় দুর্গাপুজোও।
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা বাবু বিশ্বাস বলেন, “আমরা তো নিজেদের বুক চিতিয়ে উদ্বাস্তু বলি, ছিন্নমূল বলি। যদিও আমি এখানেই জন্মেছি। তবে শুনেছি আমাদের দেশ নাকি অন্য কোথাও ছিল। একটা টান মনে সারাক্ষণ ধরে থাকে।” ছেলাভ্যানে চায়ের দোকান চালান দুলাল মণ্ডল। তিনি বলেন, “ছোটবেলায় বাবা বলে দিয়েছিল, দুর্গাপুজো যেন কখনও বন্ধ না হয়। বাবা বলেছিলেন, এই দুর্গাপুজো আমাদের পরিচয়, আমাদের লড়াই।”
এক দেশ থেকে বাসিন্দারা যখন অন্য দেশে আসেন তখন আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে সম্পর্কে নানা চড়াই-উতরাই থাকে। জলপাইগুড়ি শহরের পাশেই তিস্তার চর। বাসিন্দারা প্রথম প্রথম শহরের পুজো দেখতে যেতেন। হয়ত সমাদার পেতেন না। তাই জরুরি হয়ে পড়ে নিজেদের পুজোর। নিজেদের অস্তিত্বও জানাতে হত। তাকেই প্রবীণ দুলাল মণ্ডল ‘লড়াই’ বলেছেন।
সেই লড়াই এখনও চলছে। ঢাকের শব্দে, ধূপ-ধূনোর গন্ধে-চন্দন মাখা ফুলের পাপড়িতে গত ৪৯ বছর ধরে দুর্গাকে নৈবেদ্য সাজিয়ে লড়াই লড়ছেন একদল উদ্বাস্তু মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy