মা ফলেষু কদাচন— আড্ডার মধ্যমণি জয়ন্তদা ভাবুক কণ্ঠে বলে উঠলেন এ বার। মুখে প্রশান্তি। এক হাতে চায়ের গ্লাস। অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।
সেই সকাল থেকে লড়াই শুরু হয়েছে তাঁর। প্রথমে খাতা-কলম। তার পরে ক্যালকুলেটর। শেষে অভিধান অবধি নামাতে হয়েছে তাক থেকে। পৌনে তিন ঘণ্টার যুদ্ধ শেষে খুব যে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন, তা অবশ্য বলতে পারেন না জয়ন্তদা, জলপাইগুড়ির জয়ন্ত চক্রবর্তী। বরং নতুন আর পুরনো আয়কর কাঠামোর হিসেব কষতে কষতে এই শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছিল তাঁর। তখনই খাতা-কলম, ক্যালকুলেটর ছাপিয়ে কঠিন সব অর্থনৈতিক শব্দবন্ধের জন্য হাতড়াতে হল অভিধান। তাতেও যে বিশেষ সুবিধা হল, এমন বলা কঠিন। কারণ, ততক্ষণে আয়করের সঙ্গে যোগ হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির হার, জিডিপি, কৃষি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়।
বিকেলে আড্ডায় বসে জয়ন্তদার স্বীকারোক্তি, “বুঝলি কিনা, আমার তখন সুকুমার রায়ের গঙ্গারামের মতোই দশা। সে ছেলে মেট্রিকে উনিশবার ঘায়েল হয়ে থেমেছে। আর আমিও তিন ঘণ্টা ধরে ক্যালকুলেটার, ইংরেজি অভিধান নিয়ে হিসেব করেও বার করতে পারলাম না, বাজেটে আয়করে ছাড় দিল, নাকি আগের অবস্থাই রেখে দিল! আবার বলেছে, আমাদেরই নাকি আয়কর নিয়ম বেছে নিতে হবে। এ তো ধাঁধা!”
নিজে ইতিহাসের ছাত্র। তাই অর্থনীতিতে একটু খাটোই আছেন। বলছিলেন, ‘‘আমি তো আর শক্তিকান্ত দাসের মতো অত বিদ্বান নই যে ইতিহাস পড়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সামলাব। ছাপোষা কেরানি। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করি। বাজারের যা অবস্থা, তাতে সেই চাকরিও থাকবে কি না, ঠিক নেই।’’ আড্ডার মাঝে বসেই জানালেন, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে ৪.৩ শতাংশ হয়ে গিয়েছে বলে ‘কোম্পানি’ এসব গান গেয়েই রেখেছে।
তা হলে কী করবেন, দাদা— আড্ডা থেকেই উঠে এল প্রশ্ন। জয়ন্তদা বললেন, ‘‘সেটাই তো লাখ, থুড়ি, কোটি টাকার প্রশ্ন রে! বাজারের যা অবস্থা, তাতে পেঁয়াজ কিনতেই মানিব্যাগ হাল্কা। পেট্রল-ডিজেলের দাম সেই যে পাহাড়ে চড়েছে, নামার ইচ্ছেই নেই। উল্টে শুনছি, এ বছরই একশো টাকায় পৌঁছে যাবে। যাও-বা স্কুটারটা আছে, বেচে দেব কি না, ভাবছি।’’
পাশ থেকে কে যেন ফুট কাটল, ‘‘বেচলে আমায় বলবেন!’’ ভুরু কুঁচকে জয়ন্তদার পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কেন রে, তোকে কি মাগনায় তেল দেয়?’’ তার পর আবার শুরু করলেন, ‘‘বুঝলি তো, ব্যাপারটা বুঝতে আরও একটু পড়াশোনা করলাম। তখনই ওই ছেলের কাছ থেকে অভিধানটা আনতে হল। পড়তে গিয়ে দেখি, একশো দিনের কাজ থেকে খাদ্যসুরক্ষা, সবেতেই টাকা কমিয়ে দিয়েছে। জলপাইগুড়ির স্টেশনগুলো সব যাচ্ছেতাই অবস্থা। সেগুলোর কী হবে? রায়গঞ্জ, বালুরঘাটে যেতে আমাদের দিনমান চলে যায়। তারই-বা কী হবে?’’ গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন জয়ন্তদা। থামলেন একটু দম নিতে। আবার পাশের জন শুধলো, ‘‘আর দাদা, চা-বাগান?’’ জয়ন্তদা খেই ধরে বললেন, ‘‘সে নিয়ে আর না বলাই ভাল। কিন্তু তুই আমাদের এমপি-দের জিজ্ঞেস কর, সবাই বলবে— এই তো জেলায় জেলায় হাসপাতাল হবে। বিমানবন্দর হবে। আরে ভাই, যা আছে, সেগুলির কী হবে, তার নেই ঠিক। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। এত দিন ধরে খালি শুনছি, ‘হবে হবে’। হতে তো দেখি না!’’
গরমাগরম আলোচনার শেষে জয়ন্তদা থামলেন। চারদিক হঠাৎ শুনশান। তার মধ্যে এক অল্পবয়সি ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘‘তা হলে কি কিছুই জুটবে না, দাদা? কিন্তু আমরাই তো ভোট দিয়ে এদের নিয়ে এলাম। তার বেলা?’’ জয়ন্তদার মুখে প্রশান্তি। বললেন, ‘‘গীতায় শ্রীকৃষ্ণের বাণী পড়িসনি— মা ফলেষু কদাচন। ফলের আশা না করে গা ভাসিয়ে যা!’’ বলেই এক চুমুকে চা শেষ করে উঠলেন আড্ডার মধ্যমণি। অঙ্কন: কুণাল বর্মন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy