কেন্দ্রের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তৃণমূলের মিছিল। শিলিগুড়িতে, বৃহস্পতিবার। —বিশ্বরূপ বসাক
রাতে টিভি খুলতেই আবার নতুন সিদ্ধান্তের কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন অনেকে। পাঁচশো, হাজার টাকার নোট আর বদল করা যাবে না। তবে জমা দেওয়া যাবে। কিন্তু যাঁরা দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁদের টাকা বদল করে উঠে পারতে পারেননি, তাঁরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, লাইন কমবে আশা করে তাঁরা টাকা বদল করেননি এত দিন। এ বার ওই পুরনো নোট জমা দিয়ে আবার তা তুলতে হবে। কিন্তু যাঁদের অ্যাকাউন্টই নেই, তাঁরা কী করবেন, তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন।
সেই সঙ্গে রয়েই গিয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো। তারপরও কোথাও মিলছে পাঁচশো টাকা কোথাও বা নতুন দু’হাজারের দু’টি নোট। মাসের শেষে ভাঁড়ারে টান পড়ায় মধ্যবিত্ত বাসিন্দারা ব্যাঙ্কে লাইন দিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের সব জেলাতেই বৃহস্পতিবার দিনভর টাকার পরিমাণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ শোনা গিয়েছে। সরকারি নির্দেশ মেনে চেক দিয়ে ২৪ হাজার টাকা তুলতে গিয়ে এক বা দু’হাজার পেয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছে অনেককে। কোথাও আবার লাইন দিয়েও টাকা মেলেনি বলে অভিযোগ। সর্বত্র নোট নিয়ে শুরু হয়েছে হাহাকার।
আলিপুরদুয়ার জংশন পোস্ট অফিসের পেনসনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানান নোট সমস্যায় নাজেহাল বয়স্করা। পোস্ট অফিসে সীমিত টাকা আসছে। আবার মালদহে প্রায় তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পেনশনের পাঁচ হাজার টাকা তুলতে রতুয়া ২ ব্লকের আড়াইডাঙার বাসিন্দা ৭৪ বছরের শক্তি মিত্রের খরচ হল ২৬০ টাকা। তিনি বলেন, ৪০ কিলোমিটার পথ আসতে দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে। একই অভিজ্ঞতা রতুয়ার সম্বলপুরের বাসিন্দা ৬৪ বছরের জয়নাল আবেদিনেরও। এ দিন পাঁচ হাজার টাকা তুলতে এসে তারও সব মিলিয়ে ২২০ টাকা খরচ হয়েছে। ব্যাঙ্ক মহল সূত্রেই জানা গিয়েছে, মালদহে ২০৫টি এটিএম থাকলেও এদিন মাত্র ১২-১৪টি চালু ছিল। তাও আবার সীমিত সময়ের জন্য।
সপ্তাহের শুরুতে দুদিন সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেক দিয়ে ২৪ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বুধবার ওই অঙ্ক কমে ২০ হাজারে দাঁড়ায়। বৃহস্পতিবার সেটা একধাক্কায় দাঁড়াল ৫ হাজার টাকায়। কোচবিহার শহরের সুনীতি রোডের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় এমনটাই হয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, টাকার পরিমাণ কমেছে। কোচবিহারের বেশিরভাগ ব্যাঙ্কেই ছিল ওই ছবি। তুফানগঞ্জের আঞ্চলিক ব্যাঙ্কের একটি শাখায় ২ হাজার টাকা ছিল ঊর্ধ্বসীমা। কোচবিহারের বেশিরভাগ এটিএমও ছিল বন্ধ কিংবা টাকা শূন্য। অশোক বর্মন বলেন, “টিউশনি করে কিছু টাকা জমিয়েছি। নিজের প্রয়োজনে সেটাও তুলতে পারছি না।”
বৃহস্পতিবারও রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর, শিলিগুড়িমোড়, সুপারমার্কেট মোহনবাটী, বিধাননগর, মহাত্মাগাঁধী রোড, নেতাজি সুভাষ রোড, কলেজপাড়া ও দেবীনগর ও কসবা এলাকার বেশিরভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কে ১০০ ও ২০০০ টাকার নোটের অভাব থাকায় বাসিন্দাদের বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বদল করে দেওয়া হয়নি। এ বার তাঁরা কী করবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না।
ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের রায়গঞ্জ শাখার সিনিয়র ম্যানেজার পল্লব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, গত প্রায় একসপ্তাহ ধরে প্রতিটি ব্যাঙ্কেই চাহিদা অনুযায়ী ১০০ ও ২০০০ টাকার নোট সরবরাহ করছে না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে ওই টাকার নোট বদল, টাকা তোলা ও এটিএম পরিষেবা একসঙ্গে স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ দিনও বাসিন্দাদের বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বদল করার কাজ বন্ধ রাখেন রায়গঞ্জের মুখ্য ডাকঘর কর্তৃপক্ষ।
টাকার জোগান কমেছে বিভিন্ন এলাকার ডাকঘরগুলিতেই। তার ওপর সার্ভার বিকল হওয়ায় গ্রাহকদের জেলা জুড়ে অনলাইন পরিষেবা ব্যাহত হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। ফলে গ্রাহকদের অনেককেই ফিরে যেতে হয়। ডাক বিভাগের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ফিনাকেল নামে সার্ভার পদ্ধতিতে ডাক বিভাগের সমস্ত অনলাইন লেনদেনের কাজ চলে। সকাল থেকে ওই সার্ভার অকেজো হয়ে পড়ায় সমস্যা হয়।
ডাক বিভাগের কোচবিহারের অতিরিক্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট (হেড কোয়ার্টার) ধনঞ্জয় বর্মন বলেন, “দ্রুত পরিষেবা স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।” ডাকঘর সূত্রের খবর, ফিনাকেল সার্ভার মুম্বাই থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়। ফলে দেশ জুড়েই সমস্যা হয়েছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের মালঞ্চা এলাকার গৃহবধূ প্রতিমা বসু মেয়ের বিয়ের নগদ খরচের জন্য বৃহস্পতিবার সদর ডাকঘরে ১৫ হাজার টাকা তুলতে এসে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে যান। তার আগে তিনি পোস্টমাস্টারে কাছে গিয়ে ওই টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য বিস্তর অনুনয় বিনয় করেও কোনও ফল পাননি।
প্রতিমাদেবী বলেন, মালঞ্চায় গ্রামীণ ব্যাঙ্কের শাখায় বেশি টাকা নেই। তাঁর কথায়, ‘‘বালুরঘাটের ডাকঘরেই সেভিংস অ্যাকাউন্টে মেয়ের বিয়ের টাকা জমিয়েছিলাম। টাকা পেলাম না। কী হবে বুঝতে পারছি না।’’
বালুরঘাটের চকভৃগু পোস্ট অফিসে টাকা তুলতে গিয়ে গৃহবধূ শঙ্করী দাস অভিযোগ করেন, ১০০০ টাকা প্রয়োজন। অথচ পোস্ট অফিস থেকে তাঁকে মাত্র দুশো টাকা দেওয়া হয়েছে। শঙ্করীদেবীর ওই পোস্ট অফিস ছাড়া অন্য কোনও ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট নেই। ডাকঘরের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলিও চরম অর্থ সংকটে ভুগছে। এদিন তপনের বালাপুর বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কে টাকা তুলে সকাল থেকে গ্রাহকেরা লাইন দেন। অথচ দুপুর ১টার মধ্যে টাকা ফুরিয়ে যায়।
গ্রামীণ ডাকঘরগুলিও প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য টাকার সরবরাহ পাওয়ায় গ্রাহক ভোগান্তি চলছে। বালুরঘাট প্রধান ডাকঘরে জমাকৃত পুরনো ৫০০ ও হাজারের নোটে প্রায় ৪২ কোটি টাকা স্তুপ হয়ে পড়ে রইলেও স্টেটব্যাঙ্ক ওই টাকা জমা নিচ্ছে না। এবং পরিবর্তে প্রয়োজনীয় নতুন টাকাও দিচ্ছে না বলে অভিযোগ। ফলে ডাকঘরের গ্রাহকদের ভোগান্তি আরও বেড়ে চলেছে। কোচবিহারের বধূ মামনি রায় বলেন, “স্বামী চাকরি সূত্রে বাইরে থাকেন। সংসার খরচের যা টাকা ছিল তা শেষের দিকে। তাই এদিন সংসারের কাজ সামলে এটিএমের লাইনে টাকা তোলার জন্য দাঁড়াতে হল। কিন্তু তারপরেও টাকা পাব কিনা জানি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy