রায়গঞ্জ হাসপাতালে ভাঙচুর। নিজস্ব চিত্র।
পথ দুর্ঘটনায় জখম দুই যুবকের মৃত্যুর ঘটনার পর চিকিত্সায় গাফিলতির অভিযোগে ভাঙচুর করা হল হাসপাতালে। মঙ্গলবার বিকেলে এই ঘটনার জেরে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের এক চিকিত্সক ও তিন স্বাস্থ্যকর্মীকে একদল যুবক মারধর করে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ।
আতঙ্কে হাসপাতালের একাধিক চিকিত্সক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী ওয়ার্ড বিভিন্ন ওয়ার্ড ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান। খবর পেয়ে বিরাট পুলিশবাহিনী হাসপাতাল পৌঁছলেও তার আগে হামলাকারীরা পালিয়ে যায় বলে অভিযোগ।
হাসপাতাল সুপার অনুপ হাজরার দাবি, ‘‘হামলাকারীদের পরিচয় জানা যায়নি। অভিযুক্তরা পথ দুর্ঘটনায় মৃত ও জখমদের আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধু বলে জানা গিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘হাসপাতালের তরফে অজ্ঞাতপরিচয় একদল যুবকের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কর্তব্যরত অবস্থায় সরকারি কর্মীদের মারধর ও সরকারি সম্পত্তি নষ্টের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।’’ উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার অমিতকুমার ভরত রাঠৌর জানান, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, পথ দুর্ঘটনায় মৃত ওই দুই যুবকের নাম শিবানন্দ মন্ডল (২২) ও অরুণ মজুমদার (২৬)। দুর্ঘটনায় জখম হন লক্ষ্মী মন্ডল নামে এক তরুণীও। অরুণবাবুর বাড়ি রায়গঞ্জের ভিটিয়ার এলাকায়। শিবানন্দবাবু ও লক্ষ্মীদেবীর বাড়ি রায়গঞ্জের উদয়পুর এলাকায়। শিবানন্দবাবু লক্ষ্মীদেবীর নিজের দাদা। অরুণবাবু সম্পর্কে তাঁদের কাকা। অরুণবাবু রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া। তাঁর ভাইঝি লক্ষ্মী রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। এ দিন দুপুর ২টা থেকে লক্ষ্মীদেবীর বাংলা আবশ্যিক বিষয়ের পরীক্ষা ছিল। তাঁর পরীক্ষার সিট পড়েছিল ইটাহারের ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজে।
জানা গিয়েছে, এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ অরুণবাবু ও শিবানন্দবাবু লক্ষ্মীদেবীকে পরীক্ষা দেওয়ানোর জন্য একটি মোটরবাইকে চাপিয়ে মেঘনাদ সাহা কলেজে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মোটরবাইকটি অরুণবাবুর হলেও সেটি চালাচ্ছিলেন শিবানন্দবাবু। অরুণবাবু মোটরবাইকের মাঝে ও লক্ষ্মীদেবী পিছনে বসেছিলেন। দুপুর একটা নাগাদ তাঁরা দুর্গাপুর এলাকায় পৌঁছনোর পর লক্ষ্মী তাঁদের জানান, তিনি অ্যাডমিট কার্ড আনতে ভুলে গিয়েছেন। সেকথা শোনার পর শিবানন্দবাবু বোনের অ্যাডমিট কার্ড আনার জন্য ফের মোটরবাইকটি ঘুরিয়ে দুজনকে নিয়েই রায়গঞ্জের দিকে রওনা হন। বোনের পরীক্ষার সময় এগিয়ে আসছে দেখে শিবানন্দবাবু মোটরবাইকটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চালাচ্ছিলেন।
সেইসময় রায়গঞ্জের জামবাড়ি এলাকার ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে মালদহগামী একটি বেসরকারি বাসের সঙ্গে তাঁদের মোটরবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বাসিন্দারা বাসটিকে আটক করে ভাঙচুর করেন। শিবানন্দবাবু, অরুণবাবু ও লক্ষ্মীদেবীকে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিত্সকেরা শিবানন্দবাবুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। কিছুক্ষণ পর সেখানেই অরুণবাবুর মৃত্যু হয়। লক্ষ্মীদেবীর অবস্থার অবনতি হতে থাকায় তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অরুণবাবুর মৃত্যুর খবর জানতে পেরেই একদল যুবক হাসপাতালের পুরুষ শল্যবিভাগে কর্তব্যরত চিকিত্সক সঞ্জয় শেঠ ও স্বাস্থ্যকর্মী তপন ঘোষকে বেধড়ক মারধর করেন বলে অভিযোগ। সঞ্জয়বাবুকে লাঠিসোটা দিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। তাঁর মাথা ফেটে যায়! পাশাপাশি, অভিযুক্তরা ওই ওয়ার্ডের নার্সদের কাউন্টারের আসবাবপত্র লন্ডভন্ড করে দিয়ে ঘড়ি ও দরজার কাঁচ ভাঙচুর করে। এরপর বিক্ষোভকারীরা হাসপাতালে সিটি স্ক্যান ইউনিটের দরজার কাঁচ ভাঙচুর করে ওই ইউনিটের দুই স্বাস্থ্যকর্মী পিনাকী রায় ও সাগরবাবুকেও বেধড়ক মারধর করেন বলে অভিযোগ। স্বাস্থ্যকর্মীরা এরপর জখম ওই চিকিত্সক-সহ তিন স্বাস্থ্যকর্মীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিত্সা করান।
মৃতদের পরিবারের তরফে অবশ্য হাসপাতালে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া দেওয়া হয়েছে। অরুণবাবুর দাদা সত্যেন মন্ডলের অভিযোগ, ‘‘হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর দীর্ঘক্ষণ বিনা চিকিত্সায় পড়ে থেকে ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে লক্ষ্মীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। লক্ষ্মীকে অনেক দেরিতে সিটি স্ক্যান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, ‘‘কে বা কারা হাসপাতালের চিকিত্সক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাংবাদিকের উপর হামলা চালিয়েছে, তা আমাদের জানা নেই।’’ মারধরে জখম চিকিত্সক সঞ্জয়বাবু ও সুপার অনুপবাবু অবশ্য চিকিত্সায় গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, ‘‘শিবানন্দবাবুকে মৃত অবস্থাতেই হাসপাতালে আনা হয়। অরুণবাবু ও লক্ষ্মীদেবীর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক ছিল। চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বহু চেষ্টা করেও অরুণবাবুকে বাঁচাতে পারেননি। উন্নত চিকিত্সার স্বার্থে লক্ষ্মীদেবীকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে রেফার করা হয়।’’ পুলিশ সুপার বলেন, বাসের চালকের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy