বেশিরভাগ সময় ঘরের ভিতরেই থাকতেন। কখনও দেখা যেত ধ্যান করছেন। মাঝে মধ্যে বাইরে এসে পায়চারি করতেন। দূর থেকে দেখা যেত তাঁকে। সেই দেখার মধ্যেই অনেকে তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে। গ্রামে গ্রামে রটে গিয়েছিল, ওই যে তিনি, এই ভারতের এই দশা দেখে চিন্তায় উদ্বিগ্ন। গ্রামের মানুষ নিজেদের মনেই ভেবে নিয়েছিলেন, নেতাজি ফিরে এসেছেন। কিন্তু নিশ্চয় এমন নানা কারণ রয়েছে, যে তিনি প্রকাশ্যে আসতে পারছেন না বলে মনে হয়েছিল অনেকের। ফলে গ্রামে গ্রামে রটে গেল সেই বার্তা, শৌলমারির ওই সাধুই নেতাজি।
এই বার্তা যে কত বড় ভুল, সে কথাও সেই সময়ই উঠেছিল। তিনটি কারণ। একটি মত ছিল, নেতাজি স্বাধীনতা সংগ্রামের শহিদ। সেই অসামান্য মর্যাদা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যেতে পারে না। শৌলমারির সাধু নেতাজির সেই মর্যাদার প্রতি একটি ভয়াবহ ব্যঙ্গ। যা ভারতের ইতিহাসের পক্ষেও প্রচণ্ড অসম্মানজনক। আর একটি মত হল, নেতাজি যদি ফিরেও আসতেন, তা হলেও তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন, এমন আচরণ তাঁর চরিত্রসম্মত নয়। সোজা কথায়, সুভাষচন্দ্র বসু তেমন মানুষ ছিলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করতেন। যখন ভারত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল, সেই সময় তিনি রাজনীতির হাল ধরতে এগিয়ে যেতেন। তৃতীয় মতটি হল, যে স্বপ্নকে সঙ্গী করে ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল, অনেকের ধারণা, সেই স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল কয়েক বছর পরে। দেশের অনেক সাধারণ মানুষ তখন কোনও দেশনায়কের অপেক্ষায় ছিলেন। আর নেতাজির প্রয়াণ নিয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায়, অনেকেই বিশ্বাস করতেন, কোনও এক দিন তিনি ঠিকই ফিরে আসবেন। আর তার পরে সদ্য স্বাধীন এই দেশটির হাল ধরবেন পোক্ত হাতে। তাতেই বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ভারত।
অনেকেরই ধারণা, সেই বিশ্বাস থেকেই শৌলমারির সাধুর সঙ্গে নেতাজির মিল খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়। সেই বিশ্বাস থেকেই, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ওই সাধুই নেতাজি, তাঁরাও তাঁর কাছে ঘেঁষতেন না। সেই সাধুও কম কথা বলতেন। কেবল তাঁকে দেখতে পাওয়া যেত। আর তাতেই শুরু হতে শুরু করে কল্পনার প্রসার।
দুই জীবনীকার লেনার্ড গর্ডন এবং সুগত বসু কিন্তু পরিষ্কার বলেছেন, শৌলমারির সাধুর সঙ্গে নেতাজির কোনও সম্পর্ক নেই। তবু নেতাজির মতো রহস্যময় ভাবেই রয়ে গেলেন শৌলমারির ‘মিথ’। সংবাদ মাধ্যমে সেই বিতর্ক প্রকাশ্যে এসেছে। কিছু কিছু মহলের বক্তব্য, নেতাজির প্রয়াণ সম্পর্কে প্রশাসন কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও জানায়নি বলেই ওই বিশ্বাসটিও এখনও বেঁচে রয়েছে। তাই জেগে রয়েছে বিতর্কটিও।
বিতর্ক পাশে রেখে বরং জায়গাটা ঘুরে দেখা যাক। শৌলমারি। কোচবিহারের মাথাভাঙা মহকুমার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। মাথাভাঙার অংশ হলেও ফালাকাটা শহর ঘেঁষে ওই গ্রাম। ঘেঁষে বলতে শহর থেকে দুই কিলোমিটার ভিতরে। তখন সেই গ্রাম জঙ্গল ও নদী দিয়ে ঘেরা ছিল। আশ্রমের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে মুজনাই নদী। ষাটের দশকে এখানেরই এক সাধুকে নিয়েই হইচই পড়ে গিয়েছিল গোটা বাংলায়। বলা চলে ভারতেই। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ষাটের দশকে কে কে ভাণ্ডারি নামে এক সাধু আশ্রমে থাকতে শুরু করেন। তাঁকে অবশ্য সবাই ওই আশ্রম ও সংলগ্ন এলাকায় ‘সারদানন্দজি’ নামেই জানতেন। তাঁর বেশভূষা, চালচলন সবাইকে এক নজরে মোহিত করে নেয়। ধীরে ধীরে আশ্রমে তাঁকে ঘিরেই সব কিছু চলতে শুরু করে। অনেকেরই দাবি, ওই সাধুর চেহারার সঙ্গে মিল ছিল নেতাজির। এর পরেই তিনিই নেতাজি কি না তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। তখন নানা জায়গা থেকে বহু মানুষ গিয়েছেন আশ্রমে।
কয়েক বছর আগে নেতাজি সম্পর্কিত ফাইল প্রকাশ্যে এলে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে শৌলমারি আশ্রমের সম্পাদক রমণীরঞ্জন দাস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি পাঠান। তার সব কথা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তাতে অবশ্য ওই গ্রামের পাল্টায়নি কিছুই। কয়েক বিঘা জমির উপরে ওই আশ্রম রয়েছে এখনও। একটি বেসরকারি কমিটি ওই আশ্রমের দেখাশোনা করেন। সাধুবাবার থাকার জায়গা, ধ্যানের জায়গা থেকে থাকার ঘর পাথর বসিয়ে যত্নে রাখা হয়েছে। আশ্রম অবশ্য এখনও জঙ্গল ঘেরা। আম, জাম তো বটেই, বেল, নিম নানা গাছ দিয়ে ওই আশ্রম ঘেরা। পঞ্চবটীতে এখনও পাঁচটি গাছ রয়েছে। তবে সন্ধের পরে আশ্রমে কেউ থাকেন না। সেখানে আলোর কোনও ব্যবস্থা নেই। দিনের বেলা অবশ্য সেখানে বহু মানুষের সমাগম হয়। আসলে ওই আশ্রমের টানে ওই গ্রাম এখন বিখ্যাত। অনেকেই জানান, বহু মানুষ আসেন। মাঝে মাঝে সাধুবাবার নামে প্রসাদও দেওয়া হয়।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘বুঝলা, হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি’ গল্পের একটি অংশে লিখেছেন, .....‘‘একদিন গিয়ে দেখি অজিতদা নেই। তাঁর কর্মচারী বলল, উনি তো শৌলমারি গেছেন। নেতাজিকে দেখতে। সেই যে শৌলমারি তাঁর মাথায় ঢুকল, তারপর সব কথাই শৌলমারির সাধুকে নিয়ে। তিনিই যে নেতাজি সে বিষয়ে তাঁর তিলেক সন্দেহ ছিল না। আমাকে বোঝাতেন, বুঝলা রুনু, নাইনটিন থার্টি ফোরে আমি নেতাজিরে দেখছিলাম বইলাই শৌলমারির সাধুকে চিনতে আমার দেরি হয় নাই। হান্ড্রেড পার্সেন্ট নেতাজি।……..আমরা জানি তৎকালের বাঙালি এবং বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা রাজনীতির কূটকাচালিতে, দেশভাগজনিত সমস্যায় কণ্টকিত হয়ে তিতিবিরক্ত মনে যে উজ্জ্বল উদ্ধারের স্বপ্ন দেখত, তার নায়ক ছিলেন নেতাজি। নিরুদ্দিষ্ট নেতাজি একদিন ফিরে এসে দেশের হাল ধরবেন এবং ভারতবর্ষ পাল্টে যাবে-এই আশা অনেকের বড় বলবতী ছিল……….”।
সেই গল্পকথা এখনও ঘুরে বেড়ায় গ্রামের পথে পথে। বিরুদ্ধে যতই যুক্তি থাক, এখনও সেই বিশ্বাস নিয়েই অনেকে শৌলমারি যান। সেখানে মাথা ঠেকান দেশনায়কের উদ্দেশে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy