কোচবিহার সার্কিট হাউসে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। —নিজস্ব চিত্র।
বাংলায় আর হিংসার ঘটনা বরদাস্ত নয়। ভোট নিয়ে আর কোনও অশান্তি চলবে না। এমন কোনও ঘটনার কথা কানে এলেই তিনি যথাযথ পদক্ষেপ করবেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ চাইলে তাঁর গাড়ি দাঁড় করিয়ে অভিযোগের কথা জানতে পারেন। তিনি শুনবেন এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করবেন। শুক্রবার রাতে কোচবিহার সার্কিট হাউসে পৌঁছে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে এমনটাই জানালেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। পাশাপাশি জানিয়ে দিলেন, শনিবারই তিনি ‘অশান্ত’ দিনহাটা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসকবলিত এলাকায় যাবেন। সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে পুলিশ প্রশাসন এবং জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন।
বস্তুত, রাজ্যপালের আচমকা কোচবিহার সফর নিয়ে শুরু থেকেই কৌতূহল ছিল। পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশ ইস্তক বাংলার বিভিন্ন জায়গায় হিংসার খবর পাওয়া গিয়েছে। যে কয়েকটি জায়গায় নিত্যদিন অশান্তির খবর মেলে তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড় এবং কোচবিহারের দিনহাটা। এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের ডোমকল-সহ বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ হচ্ছে। আগেই অশান্ত ক্যানিং এবং ভাঙড়ে গিয়েছেন রাজ্যপাল। তেমনই গত বুধবার রাজ্যপালের কোচবিহার সফরের কথা প্রকাশ্যে আসতেই তিনি দিনহাটা-সহ অন্যান্য এলাকায় যাবেন কি না, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যায়। বিজেপি জানিয়ে দেয় তারা প্রতিনিধিদের পাঠাবে রাজ্যপালের কাছে। রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ জানাবে তারা। পাশাপাশি জেলায় ‘সন্ত্রাসের ইতিহাস’ সম্পর্কে রাজ্যপালকে অবহিত করবেন। অন্য দিকে, তৃণমূলও চেয়েছিল তাদের মৃত কর্মীর বাড়িতে যেন রাজ্যপাল যান। নিজের চোখে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন। সেদিন কোচবিহার সার্কিট হাউসে রাজ্যপালের দুপুর সাড়ে ৩টে নাগাদ চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু বাধ সাধে খারাপ আবহাওয়া। টানা বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়ার কারণে বাগডোগরা থেকে হেলিকপ্টারে করে কোচবিহার যাওয়ার ঝুঁকি নেননি রাজ্যপাল। তার আগের দিনই আকাশপথে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন শিলিগুড়ি চলে যান রাজ্যপাল। অবশেষে দু’দিন পর কোচবিহার এলেন রাজ্যপাল। এবং পৌঁছেই তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক করেন তিনি।
শুত্রবার রাতে রাজ্যপাল বলেন, ‘‘আমি পুরো পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শন করেছি। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে অশান্তির খবর পাচ্ছি। কোচবিহারেও হিংসার ঘটনা ঘটেছে বলে খবর পেয়েছি। আমি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় সফর বাতিল করেছি। কিন্তু আজ এবং আগামিকাল আমি এখানেই (কোচবিহারে) আছি। এলাকার প্রকৃত পরিস্থিতি ঠিক কী, সেটা নিজে দেখতে চাই।’’ তিনি এ-ও বলেন, ভোটের আগে রাজনৈতিক অশান্তিতে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চান। যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেও দেখা করবেন। তাছাড়া যে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি চাইলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন বলে জানান রাজ্যপাল বোস। বিজেপি সূত্রে খবর, শনিবার তাদের প্রতিনিধি দল রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। রাজ্যপাল সকাল ৮টায় সময় দিয়েছেন। রাজ্যপাল জানান, ‘হেল্প লাইন’ও চালু হচ্ছে।
রাজ্যপালের গাড়ি থামিয়ে অভিযোগ জানানো যাবে
ভোটের আগে অশান্তির অভিযোগ নিয়ে আগেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল বোস। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের ভূমিকাতেও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রাজভবনে ডেকেছিলেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহকে। নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার বার্তা দেন তাঁকে। ভোটমুখী বাংলায় লাগাতার অশান্তি এবং হিংসার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। হিংসা রুখতে রাজভবনে খোলা হয়েছে ‘পিস রুম।’ তা নিয়ে শাসকদল কটাক্ষ করলেও রাজ্যপাল থামেননি। শুক্রবার তিনি আরও একধাপ এগিয়ে জানিয়েছেন আগেই কলকাতার রাজভবনে ‘পিস রুম’ তৈরি হয়েছে। এখন তিনি বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন। তাই মানুষ চাইলে তাঁকে সরাসরি ভোট সম্পর্কিত হিংসা, ঝামেলা ইত্যাদির অভিযোগ জানাতে পারেন। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ আমাকে চাইলে থামাতে পারেন। আমি গাড়ি দাঁড় করিয়ে তাঁদের কথা শুনব। যেখানে হিংসার ঘটনা ঘটছে, সেখানে নিজে যাব। আমি মানুষের সঙ্গে আছি। শান্তি ফেরাতে কোচবিহারের মানুষের সঙ্গে আছি।’’
হিংসা থামাতে যে কোনও পদক্ষেপ
রাজ্যপাল বোস সাংবাদিক বৈঠকে এ-ও বলেন, হিংসা থামাতে তিনি যে কোনও পদক্ষেপ করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘ইতিমধ্যে পুলিশ আধিকারিক এবং জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। এখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের এই সব পরিস্থিতি দেখার কথা। আমরা সবাই মিলে এই রকম ঘটনার মোকাবিলা করব। হিংসা ঠেকাতে সবার সমর্থন চাই।’’ বোসের সংযোজন, ‘‘আমরা বাংলায় এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা আর বরদাস্ত করব না। আগামিকাল আমি দিনহাটা এবং কোচবিহারের অন্যান্য উপদ্রুত এলাকায় যাব।’’
বৃহস্পতিবার পাহাড়ে আটটি দলের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাজ্যপাল। সেখানেও অশান্তির অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যপালের কাছে শান্তিপূর্ণ ভোটের আর্জি জানানো হয়। অন্য দিকে, রাজ্যপাল আগেই জানিয়েছিলেন যে, ভোট-আবহে অশান্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতেই তিনি বিভিন্ন জায়গায় যাবেন। অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘অশান্তির আবহে আমি গ্রাউন্ড জিরো গভর্নর হতে চাই।’’
নজরে কোচবিহার
গত কয়েক দিন ধরে অশান্ত কোচবিহার। তৃণমূল এবং বিজেপির সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়েছে দিনহাটা। রাজ্যের মন্ত্রী উদয়ন গুহের বিধানসভা এলাকা দিনহাটা তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের লোকসভা কেন্দ্রে রক্ত ঝরেছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক তৃণমূল কর্মীর। জখম হয়েছেন অন্তত ছ’জন। এই আবহে রাজ্যপালের কোচবিহার সফর নিয়ে আলোচনা শুরু হয় জেলার রাজনৈতিক মহলে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং বা ভাঙড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষের পর যে ভাবে রাজ্যপাল ছুটে গিয়েছিলেন, কোচবিহারেও কি তিনি তাই করবেন? এ নিয়ে কৌতূহলী ছিল শাসক এবং বিরোধী, দুই পক্ষই। রাজ্যপাল জানালেন কোচবিহারের পরিস্থিতির দিকে তাঁর নজর ছিলই। জেলায় গুন্ডাগিরি আর চলবে না।
বিজেপি প্রার্থীর পর গ্রেফতার তৃণমূল প্রার্থী
তৃণমূলের দিনহাটা-২ ব্লকের বড়শাকদল গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী প্রধান তথা তৃণমূল প্রার্থী তাপস দাসকে শুক্রবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পুরনো মামলা রয়েছে। গত বুধবার বিজেপির জেলা পরিষদের প্রার্থী তরণীকান্ত বর্মণকেও পুরনো একটি মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই ঘটনার পর শুক্রবার পুলিশ সুপারের দফতরের সামনে অবস্থানে বসেন বিজেপির ছয় বিধায়ক। এর কিছু ক্ষণের মধ্যে তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রার্থী তথা বড়শাকদল গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান তাপস গ্রেফতার হন।
একদিকে যখন বিজেপি প্রার্থীকে গ্রেফতারির প্রেক্ষিতে আন্দোলন নেমেছে বিজেপির জেলা নেতৃত্ব। অন্য দিকে, তৃণমূল প্রার্থী গ্রেফতারির পর তৃণমূল জেলা নেতৃত্বের দিকেই আঙুল তুলছেন ধৃতের স্ত্রী অনিতা দাস। তিনি বলেন, ‘‘উদয়ন গুহের অঙ্গুলিহেলনে পুলিশ তাপসকে গ্রেফতার করেছে। উদয়নের সঙ্গে তাপসের মনোমালিন্য ছিল।’’ একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন পুলিশ তাঁর বাড়িতে এসে জিনিসপত্র তছনছ করেছে। তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করা হয়। এমনকি, তাঁকে মারধরও করা হয়। এই বিষয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদায়ন বলেন, ‘‘কারও সঙ্গে কারও মনোমালিন্য থাকলে কি পুলিশ কাউকে গিয়ে গ্রেফতার করতে পারে? নাকি কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে? ’’ অন্য দিকে, বিজেপি জেলা সভাপতি সুকুমার রায় বলেন, ‘‘যেহেতু উদয়ন গুহের সঙ্গে তাপস দাসের বিরোধ তৈরি হয়েছে, তাই পুরনো মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy