পর্যটনকেন্দ্র গড়তে উত্তরবঙ্গের গজলডোবার দ্রুত গতিতে কাজ করছে রাজ্য। সরকারি সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, চলতি মাসেই হট এয়ার বেলুনে চেপে মহড়া দেওয়া হবে। সব ঠিক থাকলে, আগামী জানুয়ারিতে এর উদ্বোধন করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারের দাবি, জাতীয় পরিবেশ আদালত বা ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশ মতোই কাজ হচ্ছে সেখানে। কিন্তু সরকারের দাবি কতটা যথাযথ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন পরিবেশকর্মীরাই। তাঁদের বক্তব্য, গজলডোবা নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালত স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। সেই স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ার কথা জানানো হয়নি। তা হলে সরকার সেখানে কাজ শুরু করে কী করে?
গ্রিন ট্রাইব্যুনালে মামলাকারী পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের দাবি, গজল়ডোবায় নির্মাণ নিয়ে স্থগিতাদেশ এখনও জারি রয়েছে। ফলে সেখানে নির্মাণ করার অর্থ, আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘন।
পরবর্তী শুনানির দিন আদালতের সামনে এ নিয়ে অভিযোগ করবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবের অবশ্য দাবি, তাঁরা পরিবেশবান্ধব পর্যটনকেন্দ্র গ়়ড়ার জন্য প্রতি পদক্ষেপের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা করছেন।
কিন্তু সেটাই কি সব?
পরিবেশবিদদের দাবি, সমীক্ষার ভিত্তিতে ছাড়পত্র নেওয়াটাও জরুরি। পর্যটন দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে করানো সমীক্ষার ভিত্তিতে রাজ্যের পরিবেশ ছাড়পত্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতিও নেওয়া হয়েছে। যদিও সেই অনুমতিও সব নয় বলে দাবি পরিবেশ আইন বিশেষজ্ঞদের। কেন?
পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, এর প্রধানত দু’টি কারণ। প্রথমত, সমীক্ষার ভিত্তিতে গ্রিন ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, পরিবেশগত সমীক্ষা করলেই স্থগিতাদেশ এড়িয়ে কাজ করা যায় না। সেই সমীক্ষা এবং তার ভিত্তিতে পাওয়া ছাড়পত্র আদালতে জমা দিয়ে স্থগিতাদেশ তোলার আর্জি জানাতে হয়। আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে তবেই কাজ শুরু করা যায়।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশকর্মীদের একাংশের দাবি, গজলডোবা পর্যটনকেন্দ্রের যা আয়তন, তাতে নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রের ছাড়পত্র প্রয়োজন। এক পরিবেশকর্মী জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনও ঘোষিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষিত এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যে কোনও প্রকল্পে কেন্দ্রের অনুমতি প্রয়োজন। সে দিক থেকে গজলডোবার এই প্রকল্প তো সংরক্ষিত এলাকার মধ্যেই পড়ে!
সুভাষবাবুর কথায়, ‘‘গজলডোবা তো বুনো হাতিদের যাতায়াতের পথ, যাকে ‘হাতি করিডর’ বলা হয়।’’
উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমীদের একাংশ জানান, গজলডোবার এ প্রান্তে পর্যটন কেন্দ্র হচ্ছে, আর ও-প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে মেনে বন দফতর পক্ষী অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে! তা হলে এমন জায়গায় শুধু রাজ্যের অনুমতি আদৌ পর্যাপ্ত কি না, সে প্রশ্ন তো উঠবেই। তাঁদের কথায়, দেশ-বিদেশের পক্ষীবিশারদেরা পরিযায়ী পাখির খোঁজে গজলডোবায় আসেন। গত বছরই সেখানে ‘বিন গুজ’-এর মতো বিরল পরিযায়ী হাঁসের দেখা মিলেছিল। এ বছরও ব্রাহ্মণী হাঁস, নর্দার্ন ল্যাপউইংয়ের মতো পাখিরা হাজির হয়েছে। সেখানে হট এয়ার বেলুন চেপে মানুষেরা উড়ে বে়ড়ালে বা নৌকাবিহার করলে পাখিদের অসুবিধা হবেই।
এর পরিবেশকর্মীর মন্তব্য, ‘‘শান্তি বিঘ্নিত হলে পরিযায়ী পাখিরা ঠিকানা বদলে নেয়। এই পর্যটনকেন্দ্র হলে গজলডোবা আর পাখিদের অভয়ারণ্য থাকবে না।’’ এর জন্য পরোক্ষে সরকারকেই দায়ী করেন বিশ্বজিৎবাবু। উত্তরবঙ্গের পরিবেশপ্রেমীদের একাংশে মতে, ‘‘পরিবেশ আদালতের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে পারত পর্যটন দফতর। এত তাড়াহুড়ো না করলেই ভাল করত তারা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy