উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বংশীবদন বর্মন সহ ৪৩ জনকে আদালত বেকসুর খালাস ঘোষণা করার পরে এই মামলার তদন্তে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আদালত সূত্রেই জানা গিয়েছে, ২০০৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভারতভুক্তির চুক্তি বাস্তবায়ন করে কোচবিহারকে ‘গ’ শ্রেণির রাজ্য ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয় গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের তুমুল গন্ডগোলে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় কোচবিহার। খাগরাবাড়িতে দুই আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে মারা যান। চকচকায় মৃত্যু হয় এক আইপিএস সহ তিন পুলিশকর্মীর। ঘটনার পর কোচবিহারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় অভিযোগ দায়ের করেন। পরে আইপিএস অফিসারের দেহরক্ষী গোরে তামাংও পৃথক অভিযোগ দায়ের করেন। দুটি অভিযোগের ভিত্তিতেই খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। ৯০ দিনের মাথায় গত ১৮ নভেম্বর ২০০৫ তারিখে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। চার্জশিটে বেশ কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা ছিল বলে আদালতে সংশয় তৈরি হয়।
ওই সব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, ১) অভিযুক্তদের টিআই ( টেস্ট আইডেনটিফিকেশন) হওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু তা হয়নি। তা হলে অভিযুক্তদের কী ভাবে কারা শনাক্ত করলেন? পুলিশকর্মীদের একজন সাক্ষ্যে টিভি ও সংবাদপত্রে ছবি দেখে অভিযুক্তদের চিনেছেন বলে আদালতে জানান। যা ঘটনার সময় কয়েক হাজার মানুষের ভিড়ের সময় কী ভাবে সম্ভব হয়েছে, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
২) এফআইআরে সাদা ট্যাক্সির কোনও বিষয় উল্লেখ নেই। অথচ সাক্ষ্যের সময় ওই ট্যাক্সিতে বংশীবদন বর্মন সহ গ্রেটার নেতারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশকর্মীদের মারধর শুরু করেন বলে জানান এক পুলিশকর্মী। ওই নেতাদের গাড়ির চালক পূজন ভদ্র অবশ্য সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সাফ জানান, তাঁদের গাড়ি ভেটাগুড়িতে আটকে দেওয়া হয়। বংশীবদন বর্মনদের সেখানে নামিয়ে তিনি দিনহাটা ফিরে যান।
৩) আইপিএস অফিসার মুস্তাক আহমেদে মৃত্যুর কারণ হিসাবে জখম হওয়ার পাশাপাশি জলে ডোবার কথা উল্লেখ করা হয়। অথচ এফআইআর কিংবা চার্জশিটে জল ডোবা সংক্রান্ত কোনও ঘটনার উল্লেখ করা হয়নি।
৪) ওই ঘটনার ব্যাপারে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে অভিযোগ হয়। ২১ তারিখ সকালে তদন্তকারী অফিসার ঘটনাস্থলে যান। অথচ অভিযুক্তদের ২০ তারিখ গ্রেফতার করা হয়। তদন্তের আগে সবাইকে ধরা হল কী ভাবে ?
৫) সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে যারা সাক্ষ্য দেন, তাঁরাও ভিড়ের জন্য হামলাকারীদের চিনতে পারেননি বলে আদালতে জানান।
এ সব কারণেই মামলা লঘু হয়ে যায়। পুলিশের এক কর্তার কথায়, গুরুত্বপূর্ণ ওই মামলার ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান না হওয়াতেই ওই খামতি তৈরি হয়। গ্রেটার সংগঠনের আইনজীবী শিবেন রায়ের দাবি, “মিথ্যা মামলা সাজান হয় বলেই নানা অসঙ্গতি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সত্যকে কোনও ভাবে আড়াল করা যায় না।”
এই নিয়ে পুলিশের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব বলেন, “আদালতের রায়ের প্রতিলিপি এখনও পাইনি। সেটা পেলে আমাদের আইন শাখার সঙ্গে আলোচনা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট পাঠান হবে।”
ঘটনার দিনে কোচবিহারে মৃত্যু হয় হোমগার্ড যোগেশচন্দ্র সরকারের। তাঁর খুনে অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস হলেও গ্রেটার মামলার রায় নিয়ে ক্ষোভ নেই ছেলের। যোগেশবাবুর ছেলে তাপস সরকার গত ফেব্রুয়ারিতে এনভিএফের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে কলকাতায় তাঁর প্রশিক্ষণ চলছে। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তাপসবাবু বলেন, “যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বাবাকে তো আর ফিরে পাব না। তাই আদালতের রায়ের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই।” সেই সঙ্গে তাপসবাবুর সংযোজন, বাবার মৃত্যুর পর ঘোষণা অনুযায়ী সরকার তাঁকে চাকরি দিয়েছে। বাবার পাওনা গন্ডা পেয়েছেন। সরকার সহযোগিতা করেছে।
পুলিশ বিভাগের সহযোগিতার কথা বলেছেন ওই ঘটনায় মৃত কনস্টেবল গৌরচন্দ্র ধরের পরিবারের লোকেরাও। যদিও মৃত আইপিএস মুস্তাক আহমেদের পরিবারের তরফে রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কথা খেলাপের অভিযোগ তোলা হয়। ওই ক্ষোভ রয়েছে পুলিশের অন্দরমহলের একাংশের মধ্যেও। পুলিশকর্মী খুনে তদন্তে গাফিলতি রয়েছে বলেও তাঁরা ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগ করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy