‘সুখী কে?’ মহাভারতের বনপর্বে ধর্মরূপী যক্ষ এই প্রশ্নটি করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। উত্তরে যুধিষ্ঠির ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে শাক রন্ধন করে সেই সুখী।” অর্থাৎ যাঁর ঋণ নেই এবং যিনি নিজের বাড়িতে থেকে দিনান্তে অন্তত শাক-ভাত খেতে পারেন তিনিই সুখী। মহাভারতের সেই সুখ এ ভারতে সইছে কি! অর্থনীতির নিম্ন স্তরে গ্রামগঞ্জের হাল বলছে, শাক-ভাত খেতেই ঋণ করার উপক্রম হয়েছে। আগে যে ডাঁটাশাক ৫ টাকায় দু’আঁটি মিলত, তার দাম এখন ১০ টাকা। এক আঁটি মুলো শাক কিনতে হলে ২০ টাকা দিতে হচ্ছে, যা কিনা আগে ভাবতেই পারতেন না নিম্নবিত্ত মানুষ। শুধু শাক নয়, দাম বেড়েছে সব আনাজেরই। আর শাক বা আনাজ রান্না হবে কিসে! প্রতি কেজি সর্ষের তেলের দাম এখন দাঁড়িয়েছে ১৮০-২০০ টাকা। প্রতিদিন একটু একটু করে ডিজ়েলের দাম বেড়ে চলাই যে এর কারণ, সেটাই আপাতত দাবি ব্যবসায়ীদের।
উত্তরবঙ্গের কোথাও ডিজ়েলের দাম লিটার প্রতি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। কোথাও ৯৯-এর ঘরে। জ্বালানির দাম নিয়ে এখন প্রশ্ন তুললেই কেন্দ্রের শাসক দলের নেতারা দাবি করেন, রাজ্য সরকার ডিজ়েল থেকে যে কর নেয় সেটা ছেড়ে দিক। রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের পাল্টা দাবি, জ্বালানি থেকে রাজ্যের নেওয়া করের সিংহভাগ তো কেন্দ্রের তহবিলেই জমা পড়ে। কেন জ্বালানিকে জিএসটির আওতায় আনা যাচ্ছে না, তা নিয়েও দোষারোপের পালা চলছে।
দুই শাসকের এইসব তর্ক-বিতর্কে মধ্যে, তারও অনেক আগে করোনার জেরে কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমিক-কর্মী। শহরের যে বিপণি বা শপিং মলগুলিতে যে সব নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন সেল্সম্যানের কাজ করতেন, সেখানে তাঁরা কমবেশি ৮ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। করোনার জেরে অনেকেরই ছাঁটাই হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁরা অনেকেই শহরের প্রান্তে একশো দিনের কাজে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু কাজ পাচ্ছেন হয়তো মাসে ৮-১০ দিন, টাকার হিসেবে হাজার দুয়েক। পাশাপাশি, মাসের বাকি দিনগুলিতে এ দিক ও দিক কাজ জোগাড় করে আরও হাজার দেড়েক। অর্থাৎ যে লোকটি গড় ১০ হাজার বেতন পেতেন, তাঁর আয় এখন কমে হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন হজার। সেই সঙ্গে উত্তরোত্তর বেড়েছে জ্বালানির জ্বলুনিতে নিত্যদিনের পাতের খাবারের দাম। গত বছর এ সময়ের থেকে এ বছরের ডিজ়েলের দাম অন্তত লিটার প্রতি ২০ টাকা বেশি। যার ধাক্কা এসে পড়েছে চাল-ডাল থেকে শাক-আনাজেও। কাজেই এখন দু’বেলা পেট ভরে শাক-ভাত খেতে হলেও ঋণ করার জোগাড় নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভা যখন জ্বালানির দামে সরকারের ‘নিয়ন্ত্রণ’ তুলে নেয় তখন থেকেই দেখা গিয়েছে পুরোটাই বাহ্যিক। তাঁদের দাবি, সরকারের ‘সম্মতি’তেই তেলের দাম নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ, বেশ কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম যখন ব্যারেল-প্রতি ২০ ডলারে নেমে গিয়েছিল, তখনও ভারতে তেলের দাম কমেনি। উল্টে কেন্দ্রীয় সরকার সেস বসিয়েছিল। যে কারণে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ১৪০ হোক বা ১৮০ টাকা, জ্বালানির দাম কমে না।
ডিজেলের দামের সেঞ্চুরি হাঁকানোয় নিম্নবিত্ত বাঙালির পাতে দামের ঠেলায় মাছ প্রায় কোণঠাসা। দু’বেলা শাক-ভাত খেতেই ঋণ করতে হচ্ছে গৃহকর্তাকে। আর জ্বালানির ‘ধাক্কা’য় দিনদিন যেন অর্থহীন হয়ে পড়ছে মহাভারত-বর্ণিত ‘সুখী’র সংজ্ঞা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy