‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-তে ফেলুদার উদ্দেশে মহীতোষ সিংহরায়ের উক্তি, ‘‘অবিশ্যি বৈকুণ্ঠপুরের সে জঙ্গল আর নেই। সব চা-বাগান হয়ে গেছে।’’ অঙ্কন— শৌভিক দেবনাথ (সত্যজিতের অঙ্কনের অনুকরণে)
ছিল চাদর। হয়ে গিয়েছে রুমাল! কিন্তু কাগজেকলমে এখনও শিলিগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের যা আয়তন, বাস্তবে জমি মাফিয়াদের দাপাদাপিতে তা প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছিতে এসে ঠেকেছে! কর্তৃপক্ষ স্তরের সকলে সব জানার পরেও জঙ্গলের সীমানা ক্রমশ কমে আসছে। মানচিত্র বলছে, সেই কমে যাওয়া কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে।
নিধনযজ্ঞের সূচনা যদিও সেই ব্রিটিশ আমলে। উনিশ শতকে শাল, সেগুন, শিরীষ, মাদার, চিকরাশির মতো দামি কাঠ, হাতির দাঁত, গন্ডারের শিং, ব্যাঘ্রচর্মের অবাধ লুণ্ঠন আর চা-বাগান তৈরি করতে একরের পর একর বনভূমি কাটার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেই পরম্পরা এখনও চলছে শিলিগুড়ি শহরের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে। এখন গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হয়েছে জমি মাফিয়াদের অবাধ দৌরাত্ম্য। রাতারাতি জঙ্গলের জমি সরকারি ‘বিক্রয়যোগ্য জমি’তে পরিণত হচ্ছে। ভোরের আলো ফোটার আগে হাত বদলে সেই জমিতে শুরু হয়ে যাচ্ছে নির্মাণ। অরণ্যে গড়ে উঠছে বসতি, কারখানা। বদলে যাচ্ছে জঙ্গলের মানচিত্র।
উত্তরের তরাই অঞ্চলে তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, জোড়াপানি, সাহু-সহ গোটা দশেক নদীতে ঘেরা এই বৈকুণ্ঠপুর অরণ্য বুনো হাতি-চিতাবাঘ-হরিণ-বাঁদর-গন্ডারের আস্তানা। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এই বনভূমি যে গতিতে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তাতে বন্যপ্রাণী ও মানুষের মধ্যে সঙ্ঘাত আরও বাড়বে। যার পরিণাম মারাত্মক।
রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক যদিও গোটা বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তিনি এমন পরিস্থিতি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের পাশে লোক বসবাস করছে। তাদের বাইরে বার করব কী করে! আমাদের জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি আছে। কমিটির সদস্যদের বলেছি। বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গজলডোবার দিকে আমরা একটা পাখিরালয় করছি। তবে হ্যাঁ, জঙ্গলকে ঘিরে যে বসতি গড়ে উঠছে, সেটা সমস্যার। জঙ্গল থেকে তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ব্যবসা করা যাবে না। সব খতিয়ে দেখার জন্য বন দফতরের প্রধান সচিবকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।’’
লোকশ্রুতি, মহাভারতের যুগে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসে এই জঙ্গলের উল্লেখ পাওয়া যায়। সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের সময় এই জঙ্গলেই থাকতেন দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠক। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনি ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’-তেও বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের কথা রয়েছে। ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস নিয়ে কথা বলার সময় ফেলুদাকে মহীতোষ সিংহরায় বলেছিলেন, ‘‘অবিশ্যি বৈকুণ্ঠপুরের সে জঙ্গল আর নেই। সব চা-বাগান হয়ে গেছে।’’
বাস্তবেও তাই। বন দফতর সূত্রে খবর, কাগজে-কলমে যে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের আয়তন প্রায় ২৭২ বর্গ কিলোমিটার, জমি মাফিয়াদের দাপাদাপিতে সেই বনভূমি এখন ১৬২ বর্গ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে!
জঙ্গলের মধ্যে বিশেষত নরেশ্বর মোড় আর নেপালি বস্তির মতো এলাকাগুলিতে কিছু পরিবার তিন-চার পুরুষ ধরে বন বিভাগের কৃষি পাট্টার উপর বসবাস করছে। সরকারি নিয়মে ওই জমি তারা বিক্রি করতে পারবে না। সর্বোপরি, প্রয়োজনে ওই জমি নিয়েও নিতে পারে সরকার। নেপালি বস্তির আট থেকে আশি সকলেই এই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে পরিচিত। সম্প্রতি কিছু পরিবার তাদের পুরনো কাঠের বাড়ি ভেঙে নতুন ঘর তুলেছে বটে, কিন্তু জমি কেউ বিক্রি করেনি। ওই আদি বাসিন্দাদেরই অভিযোগ, এলাকায় এখন দালালদের দাপট। গভীর জঙ্গলের গা ঘেঁষে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বহুতল। কোথাও বিঘার পর বিঘা জঙ্গল কেটে বসত তৈরি হচ্ছে। নেপালি বস্তির এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘এক সময় ফাড়াবাড়ি নেপালি জুনিয়র হাই স্কুলের মাঠ পর্যন্ত জঙ্গল ছিল। এখন ওই জঙ্গল আর নেই। বড় বড় বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে সেখানে। ওই সব বাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে, ওই রাস্তা ধরে সোজা দু’কিলোমিটার হেঁটে গেলে হয়তো জঙ্গলের দেখা মিলতে পারে।’’
কিন্তু এই ঘন জঙ্গলের ভিতর শ’য়ে-শ’য়ে ঘরদোর আর বড় দেওয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা কারখানা কার নির্দেশে গড়ে উঠছে? জঙ্গলের জমি দখল করা এই দালালচক্রের পর্দার আড়ালে কারা রয়েছেন, সে উত্তর অজানা। যদিও নেপালি বস্তিতে কান পাতলে লোকমুখে যাঁদের নাম উঠে আসে, তাঁদের অন্যতম স্থানীয় মার্বল ব্যবসায়ী স্বপন পাল। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, জঙ্গলের বহু জমিই এখন স্বপনের ‘কব্জায়’। সেই সব জমিতে গড়ে উঠেছে বহুতল আর কারখানা। কিছু জমি বাইরের লোকেদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
প্রত্যাশিত ভাবেই জঙ্গলের জমি কেনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বপন।
তাঁর কথায়, ‘‘আমি কোনও ফরেস্ট ল্যান্ড কিনিনি। যা কিনেছি, সবই রেকর্ডেড ল্যান্ড। তার সমস্ত কাগজপত্র আমার কাছে আছে।” কিন্তু কয়েক বছর আগে পর্যন্তও যে জমি জঙ্গলের পরিধির মধ্যে ছিল, তা হঠাৎ করে ‘রেকর্ড’ হল কী করে? শুধু তা-ই নয়, ওই জমি বিক্রিও হল এবং সেখানে কারখানা গড়ে তোলার ছাড়পত্রও মিলে গেল? এ সব প্রশ্নে স্বপনের স্পষ্ট জবাব, ‘‘সেটা বন দফতর বলবে, ওই জমি কী ভাবে রেকর্ড হল। আমি এটুকু বলতে পারি, আমার কাছে জমির সব কাগজ রয়েছে। বন দফতর সার্ভে করে দেখুক। যদি ওই জমি বন দফতরের হয়, নিয়ে নিক আমার কাছ থেকে। আর হ্যাঁ, ওখানে আমার নিজের ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। তারও নথি রয়েছে আমার কাছে। লাইসেন্সও রয়েছে।’’
জঙ্গলের জমি যে ভাবে অগোচরে সরকারি খাতায় কেনাবেচার জমি হিসাবে নথিভুক্ত হচ্ছে, তার উত্তর ভূমি রাজস্ব দফতরই দিতে পারবে বলে মনে করেন স্থানীয়েরা। নেপালি বস্তির বাসিন্দা তথা বিন্নাগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য বর্ষা থাপার কথায়, ‘‘আমাদের সব জমি কৃষি পাট্টা। ছোটবেলা থেকে আমরা তা-ই দেখে এসেছি। চাষবাস করে বেঁচে থাকার জন্যই কৃষি পাট্টা দেয় সরকার। কিন্তু কী ভাবে জঙ্গলের জমির কাগজ তৈরি হচ্ছে, কী ভাবে ফ্যাক্টরি তৈরি হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। গোটা এলাকা ফরেস্ট ল্যান্ড। এ ব্যাপারে বন দফতরই জবাব দিতে পারবে। আগের মতো পরিবেশ আর এখানে নেই। বাইরে থেকে লোক এসে জমি কিনছে। কোন জাদুবলে ভূমি রাজস্ব দফতরে জমির কাগজ তৈরি হচ্ছে, জানি না।’’
বনভূমি দখল করে অবৈধ নির্মাণের অভিযোগের ভিত্তিতে আমবাড়ি-ফালাকাটা ফাঁড়ি (আউট পোস্ট) থেকেও কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানিয়ে ভূমি রাজস্ব দফতর, বন বিভাগ-সহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই চিঠি আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে এসেছে। অভিযোগ, খোদ পুলিশই জমি দখলের ব্যাপারে সতর্ক করা সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি। নাম না প্রকাশের শর্তে এক পুলিশকর্মী আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘প্রতি বারই সার্ভের পর দেখা যায় জঙ্গল আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। ফরেস্টের মধ্যেই প্যারা মেডিক্যাল সেন্টার তৈরি হচ্ছে। বিশাল বাউন্ডারি (সীমানা প্রাচীর) দিয়ে ঘেরা।’’ আমবাড়ি-ফালাকাটা ফাঁড়ি থেকে পাঠানো চিঠির বিষয়ে জানতে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কমিশনার গৌরব শর্মা সবটা শুনে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না।
পরিবেশবিদরাও বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড’-এর সদস্য অনিমেষ বসু বলেন, “বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে যে ভাবে গাছ কেটে দখলদারি চলছে, তা শুধু বেআইনি নয়, এতে বন্যপ্রাণী ও মানুষের মধ্যে সঙ্ঘাত আরও বাড়বে। জমির ম্যাপ পাল্টে যাওয়া মানে তাতে ভূমি রাজস্ব দফতর নিশ্চয়ই যুক্ত। এই দখলদারি ঠেকানো বন দফতরের একার কাজ নয়। প্রশাসনের সব দফতর অর্থাৎ পুলিশ, ভূমি রাজস্ব দফতর, বনবিভাগ সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবে প্রাথমিক উদ্যোগ বন দফতরকেই নিতে হবে।’’
জঙ্গলের জমি কী ভাবে কেনাবেচার জমিতে পরিণত হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি ভূমি রাজস্ব দফতরের তরফে। রাজগঞ্জ ব্লকের ভূমি রাজস্ব আধিকারিক (বিএলআরও) শুভব্রত মৈত্র বলেন, ‘‘আমি কিছু জানি না। কিছু বলতে পারব না।’’
মুখে কুলুপ বৈকুণ্ঠপুরের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হরি কৃষ্ণেরও। তিনি বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে কোনও বিবৃতি দেওয়া বারণ রয়েছে উপর মহল থেকে। অভিযোগ থাকলে তার জবাব উপর মহলই দেবে।’’ তবে জমি দখলের অভিযোগ সম্পর্কে অবগত রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল জেটি ম্যাথু। ঘটনাচক্রে, ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হরি কৃষ্ণকেই নতুন করে জঙ্গলের সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। প্রধান মুখ্য বনপাল বলেন, “আমি ইতিমধ্যেই ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারকে বাউন্ডারি ডিমার্কেশন রি-সার্ভে করতে বলেছি। ডিজিপিএস মেশিন দিয়ে সার্ভে হচ্ছে। তাতেই জানা যাবে ফরেস্টের জমি দখল হয়েছে কি না। যদি সত্যিই ফরেস্টের জমি দখল হয়ে থাকে, তবে তা পুনরদ্ধার করা হবে।’’ তবে জঙ্গলের সীমানা নির্ধারণের সমীক্ষা করতে গিয়ে আধিকারিকদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে জানান ম্যাথু। তাঁর কথায়, ‘‘ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারই মাঝে আমায় জানিয়েছিলেন, বাউন্ডারি ডিমার্কেশন সঠিক ভাবে করা নেই বলে কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে।’’
পঞ্চাশের দশকে শিলিগুড়ি শহরের আয়তন ছিল মেরেকেটে ১৫ বর্গ কিলোমিটার। হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পুরসভা। সেই শহরের আয়তন বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটারে ঠেকেছে। শিলিগুড়ি যেমন বহরে বাড়ছে, তেমনই কমছে বনভূমি। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলের মতো মহানন্দা অভয়ারণ্যেও কমবেশি রোজই ‘কোপ’ পড়ছে বলে অভিযোগ। পরিবেশবিদদের মতে, এতেই বন্য জন্তুর বিচরণক্ষেত্র কমছে। অরণ্যে খাদ্যের আকাল তৈরি হওয়ায় তারা লোকালয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। কয়েক দশক আগেও উত্তরের বনঘেঁষা জনপদগুলিতে বন্যপ্রাণীদের ‘অবাঞ্ছিত প্রবেশ’ ছিল না। পথ হারিয়ে কালেভদ্রে কোনও প্রাণী চলে এলেও তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কিন্তু ইদানীং বন্যপ্রাণীদের লোকালয়ে প্রবেশ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শিলিগুড়ির মতো জনবহুল শহরেও বুনো হাতি, চিতাবাঘ প্রবেশ করছে। এক বনকর্মীর কথায়, ‘‘শিলিগুড়ি শহর যে ভাবে পূর্ব ও উত্তরে বাড়ছে, তাতে বনভূমি কমারই কথা। বন্যেরা লোকালয়ে আসছে, না কি আমরা ওদের এলাকায় ঢুকে পড়ছি— আগে সেটা দেখা দরকার।’’
তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন খোদ বনমন্ত্রী। তবে বৈকুণ্ঠপুরের এই রহস্য ফেলু-কাহিনির থেকে অনেক গুণ জটিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy