Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Royal Bengal Tiger

Raja Oldest Tiger: মানুষের সঙ্গে পশুর সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে, অনেক কথা মনে করাল রাজার মৃত্যু

মানুষের সঙ্গে পশুর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, মৃত প্রাণীর দেহ কী ভাবে সৎকার করা উচিত, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে।

ফাইল চিত্র।

শুভব্রত ঘোষ
শুভব্রত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২২ ১০:০৮
Share: Save:

রাজা। দেশের অন্যতম বয়স্ক বাঘ। গত সোমবার ভোরে রাজা মারা গিয়েছে। উত্তরবঙ্গের খয়েরবাড়ির ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২৫ বছর বয়সি সেই বাঘের দেহের সামনে দাঁড়িয়ে বন দফতরের অনেকে ফুল দিয়ে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দৃশ্যটা দেখে আট বছর আগে ডেনমার্কের কোপেনহাগেন চিড়িয়াখানার একটা ছবি মনে পড়ল।

২০১৪ সালের কথা। ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে সংবাদমাধ্যমে বীভৎস এক ছবি দেখলাম। বিচলিতও বোধ করলাম। ছবিটা কোপেনহাগেন চিড়িয়াখানার মৃত একটি জিরাফের। ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ। তার আশেপাশে ধারালো ছুরি হাতে কয়েক জন পশু চিকিৎসক। সঙ্গে চিড়িয়াখানার কর্মীরা। সামনে দর্শকের সারি। সকলেই মৃত জিরাফটিকে দেখছে। যেন অত্যন্ত মজার দৃশ্য! চিড়িয়াখানায় এসে মৃত জিরাফ দেখে মজা পাওয়াটাই উদ্দেশ্য!

রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর দৃশ্য দেখে সে দিনের সেই ছবিটা মনে পড়ল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, মানুষের সঙ্গে পশুর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, মৃত প্রাণীর দেহ কী ভাবে সৎকার করা উচিত, তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে!

উত্তরবঙ্গের খয়েরবাড়ির ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাজা।

উত্তরবঙ্গের খয়েরবাড়ির ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাজা। ফাইল চিত্র।

সুন্দরবনে কুমিরের হামলায় গুরুতর জখম রাজাকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় কিছু দিন চিকিৎসার পর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উত্তরবঙ্গে। মুক্ত জীবনযাপন করতে না পারলেও দীর্ঘ ২৫ বছরের জীবন শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার স্বাভাবিক মৃত্যু যথাযথ মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু কোপেনহাগেন চিড়িয়াখানায় ‘মারিয়াস’ নামের জিরাফটিকে মেরে ফেলা হয়েছিল ইচ্ছাকৃত ভাবেই। কারণ, সে নাকি প্রজননের অনুপযুক্ত! ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, ‘সারপ্লাস অ্যানিমাল’। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, মারিয়াসের বেঁচে থাকার কোনও সম্যক কারণ ছিল না। তাই তাকে গুলি করে মারা হয়! পরে মারিয়াসকে চিড়িয়াখানার দর্শকদের সামনে কেটে ফেলে, তার দেহের টুকরো সেখানকারই সিংহদের খাওয়ানো হয়েছিল। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল, সেটাই নাকি ‘বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ’। সেখানে আবেগের কোনও জায়গা নেই। পাশ্চাত্য দুনিয়ার ধারণা বলে কথা! তাই বহুলপ্রচারিতও হয়েছিল।

কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর কাছে সেই যুক্তি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। প্রথমত, মারিয়াসকে পরিকল্পিত ভাবে মারাটাই যে ভুল ছিল, তা মেনে নিয়েছেন বন্যপ্রাণপ্রেমীদের একটা বড় অংশ। দ্বিতীয়ত, কোনও প্রাণী মারা গেলে তাকে কেটে অন্য পশুকে খাইয়ে দেওয়াটাও সমর্থনযোগ্য নয়। তাই গত জানুয়ারিতে যখন দেখেছিলাম, পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানে ‘কলারওয়ালি’ নামের বাঘিনী মারা যাওয়ার পর তার শেষকৃত্যে মানুষ ফুল দিচ্ছেন, তখনই মনে হয়েছিল, বনে যে রানির মতো বাস করেছে, তার তো এমন বিদায়ই প্রাপ্য!

উত্তরবঙ্গের খয়েরবাড়ির ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা বন দফতরের কর্মীদের।

উত্তরবঙ্গের খয়েরবাড়ির ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা বন দফতরের কর্মীদের। ফাইল চিত্র।

অনেকে বলতে পারেন, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে রক্ষা করা উচিত ছিল ওই বাঘিনীর দেহ। মিউজিয়ামে তাকে বা তার শরীরের অংশ (বায়োলজিক্যাল স্যাম্পল) রক্ষা করা উচিত ছিল। দুটো বক্তব্যেই যুক্তি আছে। যে প্রাণীর সৎকার হয়ে যায়, তার ক্ষেত্রে তো এই অংশরক্ষায় কোনও অসুবিধা নেই। যদি না দেহ একেবারে বিকৃত হয়ে যায়।

মানুষের সঙ্গে পশুর সম্পর্ক ঠিক কী রকম হওয়া উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক আছে এবং থাকবে। কিন্তু একটা জিনিস দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে যে, মানুষের সঙ্গে পশুর সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মতোই। পশুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে আবেগ এখন বিজ্ঞানস্বীকৃত। পশুরা যে মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারে বা মানুষের মতো আবেগের পরিচয় দিতে পারে, তা অনেক বিজ্ঞানীই এখন বলেন। পশুর আবেগ এখন বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই পশুর ব্যবহার (ইথলজি)-এর অঙ্গ। সে দিক থেকে যদি আমরা কলারওয়ালি বা রাজার মৃত্যু এবং তাদের সৎকারের ঘটনাকে দেখি, সেখানে কিন্তু মানুষ-পশুর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্কের কথাটাই প্রথম মনে আসে। যেটা কোপেনহাগেন চিড়িয়াখানায় মারিয়াসের মৃত্যুর পরের দৃশ্যে মনে আসেনি।

রাজার জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আরও কিছু চিন্তা মাথায় ঘুরছে। বন্য অবস্থায় যদি কোনও প্রাণী বাঁচতে অক্ষম হয়, তাকে কী ভাবে সাহায্য করা যায়, সেটা রাজার জীবন দিয়ে দেখা যায়। একটি বন্য বাঘ চোট পেয়ে হয়তো স্বাধীন ভাবে থাকতে অক্ষম। তাদের বাকি জীবনটাও যাতে ভাল ভাবে কাটে, সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। বন্যপ্রাণ পুনর্বাসন কেন্দ্রের তো এটাই কাজ— যে সব বন্যপ্রাণী জঙ্গলে থাকতে পারছে না বা পারবে না, তাদের একটা দ্বিতীয় ঘর বা দ্বিতীয় জীবনের সুযোগ করে দেওয়া। খয়েরবাড়ি পুনর্বাসন কেন্দ্রে একটি সার্কাস কোম্পানির ১১টি বাঘকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সাধুবাদযোগ্য। সেই জায়গাটি জলদাপাড়ায় সংরক্ষিত অরণ্যের ১৫ কিলোমিটার দূরে। বাঘ ছাড়াও বেশ কিছু চিতাবাঘ, যাদের সঙ্গে মানুষের সঙ্ঘাত হয়েছে, তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেখানে।

বাঁ দিকে, কোহিমা চিড়িয়াখানায় বাঘ জেরি। ডান দিকে, আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ ও সিংহের সংকর রুদ্রাণী এবং সিংহ দেবব্রত।

বাঁ দিকে, কোহিমা চিড়িয়াখানায় বাঘ জেরি। ডান দিকে, আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ ও সিংহের সংকর রুদ্রাণী এবং সিংহ দেবব্রত। ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে।

রাজার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আরও কিছু দীর্ঘায়ু বাঘ ও বৃহৎ মার্জারের কথা মনে পড়ছে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে রাজস্থানের জয়পুর চিড়িয়াখানায় মারা যায় ‘রামু’ নামে একটি বাঘ। তার বয়স হয়েছিল ২৪। ২০১৪ সালে কানপুর চিড়িয়াখানায় মারা যায় ২৬ বছর বয়সি ‘গুড্ডু’। সাধারণ ভাবে বন্য বাঘ বছর পনেরো মতো বাঁচে। বন্দি অবস্থায় বাঘের আয়ু অনেক ক্ষেত্রেই বাড়তে দেখেছি। কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় দু’টি খুব সুন্দর সংকর প্রাণী ছিল। বাংহ— বাঘ ও সিংহের সংকর (টাইগার-লায়ন হাইব্রিড ‘টাইগন’)। নাম ছিল ‘রুদ্রাণী’ ও ‘রঙ্গিনী’। ছোটবেলায় জাদুর মতো আকর্ষণ করেছে রুদ্রাণী-রঙ্গিনী।

সংকর প্রাণীর আলাদা ও অপরিসীম বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব আছে। তা নিয়ে আগ্রহ থাকার কারণেই রুদ্রাণী-রঙ্গিনীর জীবন নিয়ে খুব গভীর ভাবে আকর্ষিত হয়েছি। রুদ্রাণীর জন্ম ১৩ অক্টোবর, ১৯৭২। আর রঙ্গিনীর জন্ম ৮ মার্চ, ১৯৭৪। রুদ্রাণী ১৯৯৬ সালে মারা যায়। আর রঙ্গিনী ১৯৯৮-তে। দু’জনেরই বয়স হয়েছিল ২৪। যা বৃহৎ মার্জার প্রজাতির পক্ষে খুব বেশি। জাদুকর পি সি সরকার (জুনিয়র)-এর পোষা একটি সিংহ ছিল। সম্রাট। সে বেঁচে ছিল ২৩ বছর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সব বাঘ, সিংহ বা বৃহৎ মার্জার প্রজাতির প্রাণীর বন্দিদশায় দীর্ঘায়ুর কারণ, বন্য জীবনের মতো তাদের অনেক সংগ্রামের সম্মুখীন হতে হয় না। এবং তারা অনেকাংশে যত্ন পায়। যা বনের কঠিন জীবনে পাওয়া মুশকিল।

রাজার মৃত্যুর খবর অনেক স্মৃতিই ফিরিয়ে দিল। বিশেষত, ভারত-সহ বিভিন্ন জায়গায় চিড়িয়াখানা ঘোরার স্মৃতি। ‘ইন্ডিয়ান জু এনকোয়ারির প্রজেক্ট’-এর সৌজন্যেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চিড়িয়াখানার প্রাণীদের হাল হকিকত পর্যবেক্ষণই ছিল ওই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

১৯৯৮ সালে নাগাল্যান্ডের কোহিমা চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখিয়েছিলেন বন দফতরের এক আধিকারিক। ঘুরতে ঘুরতে একটা খালি খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সঙ্গী বনাধিকারিক ডাকতে আরম্ভ করলেন, ‘‘জেরি! জেরি!’’ খাঁচার ভিতরের কামরার ভিতর থেকে এক জোয়ান বাঘ বেরিয়ে এল। গারদের কাছে আসতেই সঙ্গী তার গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে থাকলেন। লোভ সামলাতে পারছিলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘গায়ে হাত দেব?’’ সঙ্গী বললেন, ‘‘দিন না!’’ সেই প্রথম একটা জ্যান্ত বাঘকে আদর করি খাঁচার বাইরে থেকে। অনেক ক্ষণ আদর খাওয়ার পর জেরি দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতে থাকল। আমরা তখন হাঁটতে আরম্ভ করেছি। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, জেরির সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন জেরি বেঁচে নেই নিশ্চয়ই। বেঁচে থাকার কথাও নয়। যখন মারা গিয়েছিল, আশা করি, ওর মৃতদেহের উপরেও কেউ রাজার মতো শেষ নমস্কারের ফুল দিয়েছিল। ভারতের জাতীয় পশুর তো এই সম্মানটা প্রাপ্য!

(লেখক ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর ওয়াইল্ড লাইফ প্রজেক্ট ম্যানেজার। মতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

Royal Bengal Tiger raja Alipore Zoo wildlife
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy