অঙ্কন: অমিতাভ চন্দ্র
শরতের নীল আকাশ। ভাসছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। ‘মা, রথে করে দুর্গা আসছেন। দেখো, অসুরের সঙ্গে দুর্গার যুদ্ধ হচ্ছে’। ঘর থেকে জানলা দিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, চিৎকার করে আমাকে ডাকত সাহিন।
এই যেন বছর পাঁচেক আগের কথা। ছেলের কথা শুনে মুচকি হেসেছিলাম। ছেলেকে বলেছিলাম, ‘কোথায় শুনেছিস এ সব কথা’? ঘাড় নেড়ে ছেলে বলত, ‘কৈলাসের শ্বশুরবাড়ি থেকে দুর্গা তাঁর চার ছেলে-মেয়ে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে বাপের বাড়িতে আসেন। তার পরেই পাড়ায় পাড়ায় মণ্ডপে পুজো হয়। স্কুলে বন্ধুদের কাছে শুনেছি’। ছেলের কথায় হাসতাম। স্কুলের মাস্টারমশাইরা বলতেন, আমার ছেলে পড়াশোনায় বেশ ভাল। ছেলের কল্পনাশক্তি ছিল। সে কারণে নাকি ভাল লিখতে পারত। বাড়ির কাজের ফাঁকে সে দিন দুপুরে আমিও উঠোন থেকে তাকিয়েছিলাম আকাশের দিকে। তবে ছেলের মতো শরতের আকাশে মেঘের মধ্যে দুর্গাকে দেখতে পাইনি। দেখতে পাইনি দুর্গা-অসুরের যুদ্ধও। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখেছি শুধু।
দেবী দুর্গার গল্প-গাথা লোক মুখে শুনেছি। শুনেছি, দুর্গা হিন্দু-বাঙালির কাছে ঘরের মেয়ে। দুর্গারও ঘর, সংসার আছে। স্বামী, চার ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। পুজোর সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপেরবাড়িতে ঘুরতে আসেন তিনি। পাঁচ দিন ধরে বাবার বাড়িতেই থাকেন। দশমীর দিন থেকে মেয়েকে বিদায় দেওয়ার পালা শুরু হয়। নদীর ঘাটগুলিতে শোভাযাত্রা করে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যেতে দেখেছি। ছেলের জন্য মণ্ডপে গিয়ে দুর্গা ঠাকুরও দেখেছি। ইদে কেনা নতুন জামা পরে বন্ধুদের সঙ্গে দুর্গা ঠাকুর দেখতে যেত ছেলে।
এ বার শরতের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুর্গার গল্প বলা ছেলেটাও আর নেই। কত বয়স হয়েছিল ওর? মোটে কুড়ি বছর। উচ্চ মাধ্যমিকে ৪১০ নম্বর পেয়ে পুখুরিয়ার কোকলামারি হাই স্কুল থেকে পাশ করেছিল। ভর্তিও হয়েছিল মালদহ কলেজে। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অভাব দেখে পড়া ছেড়ে ছেলে চলে গেল কাজে। বাইরে কোথায় কোথায়! ভাল ছাত্র থেকে হয়ে গেল পরিযায়ী শ্রমিক। এখন কথাটা খুব শুনি।
আমার স্বামীও পরিযায়ী শ্রমিক। পুখুরিয়ার চৌদুয়ার গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করে। সবার সঙ্গে রেল-সেতু নির্মাণের কাজে গিয়েছিল সাহিনও। পাহাড় ঘেরা জঙ্গলে সেতুর এক থাম থেকে অন্য থামে লোহার খাঁচা বসানোর কাজ করছিল। কাজের ছবি দেখেই মনে ‘কু’ ডাকত। ছেলেকে নিষেধ করতাম। ছেলের বাবাকেও। সে-ও ছিল ওখানে। বিছানায় শুয়ে দুর্গা ঠাকুরের গল্প বলা ছেলেটা তখন উত্তর দিত, ‘কাজ না করলে সংসারের হাল কী করে ফিরবে’!
২৩ অগস্ট। আকাশ ছিল শরতের দুপুরের মতো। নীল। কিন্তু মিজ়োরামে কি আসমানে কালো মেঘ ঢেকেছিল? ওই সেতু, ওদের মতো পরিযায়ীদের হাতে তৈরি হওয়া সেতু আচমকাই ভেঙে পড়েছিল। পাহাড়ি এলাকায়। শুনেছি, ছেলেটাকে সুদ্ধু একটা থাম ভেঙে খালে পড়ে গিয়েছিল। দু’দিন ধরে কোনও খোঁজ ছিল না ওর। আকুল হয়ে কেঁদেছি আর মনে মনে বলেছি, ছেলেটাকে ফিরিয়ে দাও!
তার পরে মিলল ছেলেটা। পাহাড়ের খাদে। নিথর হয়ে পড়েছিল। এখনও কথাটা ভাবতে বুক ফেটে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। গ্রামেরই মসজিদ মাঠে ছেলেকে নিয়ে এসে রাখা হয়েছিল। কত মানুষ ছেলেকে দেখতে ভিড় করেছিল।
এই তো, সে দিনের কথা। হাসপাতালে সাহিনকে জন্ম দিয়েছিলাম। ফুটফুটে ছেলে। গায়ের রং ফর্সা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসতেই পাড়া-পড়শিরা ভিড় করেছিলেন। ছেলেকে দেখে গ্রামের সবাই বলত, কার্তিকের মতো চেহারা। আমার নামের সঙ্গে মিলিয়েই ছেলের নাম রাখা হয়েছিল। আমার নাম সাহিনা। ছেলের নাম সাহিন।
(কথার মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বারো বছরের মেয়ে)
এই মেয়েই আমার কাছে এখন ছেলে, মেয়ে। দুর্গার মতো আমিও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ইদে বাবার বাড়ি যেতাম। কী আনন্দে দিন কাটত! ইদে বিরিয়ানি, সিমুই রান্না হত। প্রতিবেশী বাড়িতে গিয়ে সিমুই, বিরিয়ানি দিয়েও আসতাম। দুর্গাপুজোর সময়ও ছেলের আবদার থাকত, ইদের মতো তখনও যেন বিরিয়ানি রান্না করে দেওয়া হয়।
দুর্গার মতো ছেলেকে আগলে রাখতে পারলাম না। মালদহে হিন্দু, মুসলিম, সব সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। সব ধর্মের উৎসব, সবার জানা থাকে। দুর্গাপুজোর আগে, মহালয়া হয়। হিন্দু পরিবারের অনেক সদস্যদের নদী ঘাটে গিয়ে পূজা-অর্চনা করতে দেখেছি। ছেলের মুখেই শুনেছিলাম, মহালয়ার দিন ভোরবেলা দুর্গার অসুর বধের
গল্প টিভি-তেও দেখানো হয়। মহালয়ার ভোরে পাশের হিন্দু পাড়া থেকে ভেসে আসত রেডিয়োর সুর। দুর্গার লড়াইয়ের অনেক কাহিনি শুনেছি। টিভিতে দেখেছি, পার্বতী অসুর নিধনে কী ভাবে দুর্গা হয়ে উঠেছিলেন। আর মা হিসাবে সন্তানকে রক্ষা করতে, নিজের
স্বামী শিবের সঙ্গেও লড়াইয়ে নামতে তৈরি হয়েছিলেন। শিবের ত্রিশূলের ঘায়ে গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ হয়েছিল। ছেলের দেহ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মা পার্বতী। পরে, গণেশের শরীরে হাতির মাথা বসানো হয়। লোকমুখে শুনেছি, শিব নাকি প্রলয়ের দেবতা। তার পরেও নিজের ছেলেকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন দেবী।
আমি পারিনি। গ্রামেরই কবরস্থানে মাটির নীচে ঘরে শুয়ে আছে ছেলে। মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে। তার পরে, ফের আমাকে আকাশের মেঘ দেখে দুর্গার বর্ণনা দেবে। আমাকে দুর্গা পুজোর গল্প শোনাবে। এখন দুর্গা পুজো। সেজে উঠছে শহর, গ্রাম। রংয়ের প্রলেপ পড়ছে বাড়ি-বাড়িতে। যদি গ্রামেই বাড়িতে বাড়িতে রংয়ের কাজ করত ছেলে, তা হলে হয়তো....
ছেলেটা নেই। মন কিছুতেই মানে না। ছেলের মতো এখন আমিও আকাশের দিকে চেয়ে থাকি। আর মেঘের মধ্যে খুঁজি আমার সাহিনকে।
(মালদহের সন্তান হারানো মা)
অনুলিখন: অভিজিৎ সাহা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy