Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ভক্তিনগর

তোলাবাজি হয় পুলিশের সামনেই, অভিযোগ

তোলা আদায়, অন্যের জমি দখল, নানা আসামাজিক কারবারের সঙ্গে যুক্ত সেই নামগুলি বেশিরভাগ একই আছে। শুধু পাল্টেছে পতাকার রং। বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, ভক্তিনগর-ডাবগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘দাদাগিরি’ চলছেই সেই চক্রের। বাম আমলে সিপিএমের প্রয়াত জোনাল সম্পাদক বিডি সিংহের কেমন ক্ষমতা ছিল, সেই গল্প এখনও এলাকাবাসীর অনেকের মুখে ফেরে।

শিলিগুড়ির ভক্তিনগরে খুনে অভিযুক্তের সিন্ডিকেটের অফিস ভাঙচুর।

শিলিগুড়ির ভক্তিনগরে খুনে অভিযুক্তের সিন্ডিকেটের অফিস ভাঙচুর।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০৪
Share: Save:

তোলা আদায়, অন্যের জমি দখল, নানা আসামাজিক কারবারের সঙ্গে যুক্ত সেই নামগুলি বেশিরভাগ একই আছে। শুধু পাল্টেছে পতাকার রং। বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, ভক্তিনগর-ডাবগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘দাদাগিরি’ চলছেই সেই চক্রের।

বাম আমলে সিপিএমের প্রয়াত জোনাল সম্পাদক বিডি সিংহের কেমন ক্ষমতা ছিল, সেই গল্প এখনও এলাকাবাসীর অনেকের মুখে ফেরে। রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে একদা বিডি সিংহের একান্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কয়েকজনকে দল পাল্টে ফেলতে দেখেছেন বাসিন্দারা। শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলের একাধিক নেতা এখন ওই এলাকায় কর্তৃত্ব কায়েম করেছেন বলেও বাসিন্দাদের অভিযোগ।

বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ এটাও যে, তৃণমূলের নেতাদের একাংশের মদতেই সোমবার ভোররাত থেকে ভক্তিনগর থানার সামনে যেভাবে পুলিশের সামনেই একদল যুবক যেভাবে অবরোধ করে আগুন লাগিয়ে ‘তান্ডব’ চালিয়েছে। লাঠিচার্জ করলে থানায় হামলা করা হবে বলে প্রকাশ্যে পদস্থ পুলিশ অফিসারদের হুমকিও দিতেও এদিন দেখা গিয়েছে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, পুলিশের একাংশের মদতেই সেবক রোড জুড়ে অসামাজিক কাজকর্ম চলছে। থানার উল্টোদিকে জাতীয় সড়কে ধারে একাধিক হোটেল, ধাবায় দীর্ঘদিন ধরে মদের কারবার চললেও পুলিশ কোনওদিনই তা চোখে দেখেনি। এমনকি, থানার অদূরে মাদকের কারবার চললেও যথাসময়ে ব্যবস্থা কোনওদিনই নেওয়া হয়নি। এর জেরেই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে এক ‘শ্রেণির’। অভিযোগ, এদের অনেকেই পার্টির ছত্রছায়ায় থাকা কোনওদিনই তাদের সেভাবে ছুঁয়ে দেখার সাহস পায়নি পুলিশ।

চলছে জাতীয় সড়ক আটকে তাণ্ডব।

শালুগাড়ার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কোনও সময় কারও সঙ্গে শাসক দলের গোলমাল হলেই সে পুলিশের নজরে আসে। তার পরেই ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটে। অতীতে বহু ঘটনা ঘটেছে শিলিগুড়ি শহরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র করে পরিচিত সেবক রোড এলাকায়। পাহাড়ের গাড়ি থেকে টাকা আদায়, জমির দালালি এবং তোলাবাজির অভিযোগও নতুন কিছু নয়। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত নানা ভাবে টাকা আদায় করা হয়। সেখানে অনেক সময়ই পার্টির নেতাদের প্রয়োজন, দলীয় কর্মসূচির কথা বলা হয়। পুলিশের একাংশও নিয়মিত টাকা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিন ঘটনার সময় ভক্তিনগর এলাকায় যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি বলেন, “এলাকায় অসামাজিক কাজকর্ম হচ্ছে বলে শুনছি। বিভিন্ন সিন্ডিকেট চলছে বলেও খবর পেয়েছি। সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।”

বস্তুত, শিলিগুড়ির সেবক রোডের সরকারপাড়ার যুবক দীপঙ্কর রায় খুনের ঘটনায় পরিবারের লোকজন থেকে এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই দুষছেন তৃণমূলকেই। সেই সঙ্গে পুলিশের ভূমিকাতেও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এদিন ঘটনার পর থানার সামনে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক কয়েক দফায় অবরোধ করে উত্তেজিত তৃণমূল কর্মীরা। তৃণমূলের জেলা নেতৃত্বদের অনেককেই তাঁদের আটকানোর চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ঘটনায় ক্ষুব্ধ কর্মীরা কেউই দলীয় নির্দেশ শোনার দিকে পা মাড়াননি। বরং কাউকে পাল্টা হুমকি দিতে দেখা গিয়েছে, দ্রুত বাকিদেরও গ্রেফতার করা না হলে আরও বড় ধরণের গণ্ডগোলের জন্য প্রস্তুত থাকুক সকলে।

চলছে জাতীয় সড়ক আটকে তাণ্ডব।

এর পরেই প্রশ্ন ওঠে, থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বসে কীভাবে প্রধান অভিযুক্ত মনকুমার রাই ও তার দলবল ট্যাক্সির ব্যবসার আড়ালে মাদকের কারবার চালাচ্ছিল? পুলিশের একাংশের বিরুদ্ধে মাদকের কারবারে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছেন বাসিন্দা থেকে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশও। বাম আমলে সিপিএমের আশ্রয়ে থাকা এই মাদকের কারবারিরা বর্তমানে তৃণমূলে যোগ গিয়ে নিশ্চিন্তে তাঁদের কারবার চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এই ফাঁদে পা দিয়ে কাঁচা পয়সার লোভে এলাকার যুবকেরা বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে।

এদিন সকাল আটটা থেকে ভক্তিনগর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন মৃতের পরিবারের লোকজন ও এলাকার বাসিন্দারা। এরপরেই ১১ টা নাগাদ ঘটনাস্থলে যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি সবাইকে দলীয় কার্যালয়ে যেতে নির্দেশ দেন। উত্তেজিত জনতা দলীয় কার্যালয়ে যেতে অস্বীকার করেন। সঞ্জয় সুব্বা নামে এক ব্যক্তি বলেন, “একজন খুন হয়ে গেল, আর মন্ত্রী দলীয় কার্যালয়ে বসে বিবৃতি দেবেন তা হতে পারে না। এর পরেই জাতীয় সড়ক অবরোধ করে জনতা। মনকুমারের অফিসটি ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আগুন দেওয়া হয় মনকুমারের বাড়িতেও। গোটা ঘটনায় দলকে দায়ী করেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থতদের অনেকে। একজন প্রবীণ তৃণমূল কর্মী অভিযোগ করেন, দলের প্রশ্রয়েই এক শ্রেণির মাফিয়ার দলে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে ও পুলিশের মদত রয়েছে।

আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর তা নেভাতে আসে দমকল।

উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী অবশ্য সিপিএমের দিকে আঙুল তুলেছেন। বলেন, “এরা সকলেই সিপিএমের লোক।” সিপিএমের দিকে অভিযোগ করলেও পুলিশের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হয়েছে বলে জানান তৃণমূল জেলা নেতা কৃষ্ণ পাল। তিনি বলেন, ‘‘গোটা ঘটনার পিছনে সিপিএমের চক্রান্ত রয়েছে। মনকুমার সিপিএমের স্থানীয় কমিটির সদস্য।” তবে পুলিশের কয়েকজন সহকারী সাব ইন্সপেক্টর ঘটনায় জড়িত ছিল বলে তিনি দাবি করেন। পুলিশ একটু সক্রিয় হলে খুনের ঘটনা এড়ানো যেত বলে দাবি করেছেন তৃণমূলের যুব নেতা রঞ্জন সরকারও। তিনি বলেন, “স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের ভূমিকায় যে গলদ পাওয়া গিয়েছে, তা নিয়ে যথাস্থানে অভিযোগ পাঠানো হয়েছে।” সিপিএমের ডাবগ্রাম জোনাল কমিটির সম্পাদক দিলীপ সিংহ বলেন, “মনকুমার আমাদের কর্মী ছিলেন। তা বলে খুনের সঙ্গে রাজনীতি নেই। আমরা চাই সব দোষীরা ধরা পড়ুক।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “লেনদেনের গোলমালের জেরে ওই ঘটনা ঘটেছে কি না তা পুলিশ খতিয়ে দেখুক। এর পেছনে কোনও রাজনীতি নেই।” পুরো ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রমাণ বলে দাবি করেন বিজেপির দার্জিলিং জেলা সভাপতি রথীন বসু। তাঁর অভিযোগ, “গোটা রাজ্যেই তৃণমূল ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যেখানে দরকার, সেখানে পুলিশ দর্শক। কোথাও আবার পুলিশ অতি সক্রিয়।”

সোমবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

নৈরাজ্যের ৬ ঘণ্টা

সকাল ৯টা: ছোট্টুর দেহ উদ্ধারের পরে মূল অভিযুক্তকে ধরার দাবিতে ভক্তিনগর থানার সামনে তৃণমূলের জমায়েত। বিক্ষোভ শুরু।

সকাল ১০টা: তৃণমূলের জেলার নেতাদের উপস্থিতিতে থানা ঘেরাও। আইসির ঘরে তৃণমূলের নেতারা বসে অসামনাজিক কাজকর্মে মদতের অভিযোগ তুললেন। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ।

সকাল ১১টা: এলাকায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। এলাকায় সমাজবিরোধী কাজকর্ম চলছে বলে পুলিশের সামনেই ক্ষোভ, রাস্তায় নেমে আন্দোলনের হুমকি মন্ত্রীর।

বেলা ১২টা: মন্ত্রী যেতেই পুলিশের সামনে চেকপোস্ট নামিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ, অভিযুক্তদের অফিসা, বাড়িতে ভাঙচুর, আগুন।

দুপুর ১টা: সেবক রোড, দুই মাইলের সমস্ত দোকান, শপিং মল জোর করে বন্ধ।

বেলা ৩টে: আচমকা দোকানপাট বন্ধ হওয়ায় গোলমালের ভয়ে যানবাহন কমে যায়। নিত্যযাত্রীদের ভোগান্তি চরমে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE