শুক্রবার মানিকতলা ডিসি অফিসে কলকাতা পুলিশের সংগ্রহশালায় নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমি এই রিপোর্টের কয়েকটা পাতা দেখেছি। যাতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ১৯৪৫ সালের অগস্টের পরেও নেতাজি বেঁচেছিলেন।’’ শনিবার অধিকাংশ ফাইল মোটামুটি খতিয়ে দেখে নেতাজির ভাইপো-বৌ কৃষ্ণা বসুর উপলব্ধি, ‘‘লোকের মনে যে পরিমাণ প্রত্যাশা জাগানো হয়েছিল, তিনি বিমান দুর্ঘটনার পর সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছেন বা রাশিয়া চলে গিয়েছেন, সেই সব তথাকথিত রহস্যের কিছুই নেই।’’
তা হলে ইঙ্গিত মিলল কীসে? একটি ফাইলের নথি বলছে, ১৯৪৮ সালের ৫ মার্চ নয়াদিল্লির তথ্য ও সম্প্রচার দফতরের চিনা কর্মী চৌ হুয়াও কুং অমিয়নাথ বসুকে চিঠি লিখছেন, ‘‘আমি এখনও বিশ্বাস করি, উনি বেঁচে আছেন।’’ কিন্তু বিশ্বাসের উল্টো দিকে অন্য তথ্যও রয়েছে। ওই ফাইলেই আছে, ১৯৪৭ সালের ১৬ নভেম্বর নিমতলাঘাট স্ট্রিটের কাছে সুভাষচন্দ্রের মূর্তি উদ্বোধন হচ্ছে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর শাহনওয়াজ খান সেই মূর্তিকে স্যালুট করেছেন, শহীদদের স্মরণে সমবেত জনতা দু’ মিনিট নীরবতা পালন করেছে। ২৮ নম্বর ফাইলে বলা হচ্ছে, ১৯৪৬ সালে কলকাতায় আজাদ হিন্দ দিবসে সুভাষের ছবিতে মালা পরিয়ে মিছিল করা হল। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বাজিয়ে শোনানো হল তাঁর তিন বছর আগের বক্তৃতা। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ বলা যেতে পারে। মারা না-গেলে মাল্যদান বা শহিদ স্মরণে নীরবতা পালন হতে যাবে কেন?
শুধু কৃষ্ণা বসু নন, তাইহোকু দুর্ঘটনার তত্ত্ব যিনি খারিজ করে দেন, অমিয়নাথ বসুর ছেলে সেই চন্দ্র বসুরও আক্ষেপ, ‘‘ফাইল থেকে জোরালো কিছু পাওয়া যায়নি।’’
হার্ভার্ডে বসে কৃষ্ণা বসুর পুত্র, সাংসদ সুগত বসুরও মনে হয়েছে, ‘‘জোরালো কিছু পাওয়ার কথাও ছিল না। শুনলাম, দু’ একটা ফাইলে কিছু জল্পনা আছে। নতুন কিছু নয়। যুদ্ধের সময় পুলিশ রিপোর্টে এ সব জল্পনা, গুজব উল্লেখ করা হয়েই থাকে।’’ তাঁর লেখা নেতাজির জীবনী ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট’-এ ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে নেতাজির মৃত্যুর কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সুগত। গোপন নথির তথ্য কি তা হলে ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট’-এর ইতিহাসবিদের জয়? ‘‘জয়-পরাজয় কিছু নয়। ইতিহাসবিদ হিসেবে মনে হয়, সব নথি প্রকাশ করা উচিত। মমতা সে দিক দিয়ে মূল্যবান কাজ করেছেন। কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট লেখার জন্য ২০১০ অবধি প্রকাশিত প্রায় সব ফাইল আমি পড়ে ফেলেছিলাম। ফলে ডিক্লাসিফায়েড ফাইলে নতুন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য আশা করিনি।’’
তাঁর বাবা শিশির বসু, নেতাজী ভবনের ওপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়েও যে গোপন নজরদারি চলছিল, সেটি অবশ্য সুগতের কাছে নতুন তথ্য। ‘‘গত কাল ডিক্লাসিফায়েড ফাইল পড়ে এক বন্ধু আচমকা ক্ষমাপ্রার্থনা করে একটা চিঠি পাঠালেন। তাঁর দাদাশ্বশুর পুলিশে কাজ করতেন, আমার বাবার ওপর নজরদারি করতেন। আমিও উত্তর দিলাম, অযথা লজ্জা পেয়ো না। এ বিষয়ে তোমার বা তোমার স্ত্রীর কোনও দায় নেই। ঔপনিবেশিক সরকারের নিয়মই ছিল এ রকম। ভারতীয় রাজনীতিকের পিছনে ভারতীয় গোয়েন্দা।’’
কিন্তু ক্লাসিফায়েড ফাইল এখনও যে অনেক! নেহরু থেকে নরেন্দ্র মোদী অবধি সব প্রধানমন্ত্রীই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণ দেখিয়ে কেন্দ্রের মহাফেজখানায় থাকা ১৮০টি ডিক্লাসিফায়েড ফাইল এখনও প্রকাশ করলেন না যে! ‘‘এখনই করা উচিত’’, বলছেন সুগত। ‘‘দুনিয়া অনেক বদলে গেছে। ১৯৪৫-এর সেই সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, জাপান আর নেই। ব্রিটিশরা চেয়েছিল, সুভাষ তুরস্ক দিয়ে জার্মানি পাড়ি দেওয়ার পথে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে মেরে দেবে। এ জন্য কি আমরা তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনের ওপর রাগ করব?’’
এ সব ইতিহাসবিদের কথা। কিন্তু ফাইল প্রকাশের পর ২৪ ঘণ্টা ধরে হরেক জল্পনা বুঝিয়ে দিল, ইতিহাসের সুভাষই সব নন। তাঁর বাইরে জনজীবনে আর এক সুভাষ আছেন। যিনি সামরিক পোশাকে মৃত্যুহীন প্রাণ, গাঁধী-নেহরু লবির সঙ্গে সমান তালে লড়ে যান! ‘‘মানুষের এই ভালবাসাটাকে আমি সম্মান করি। কিন্তু যোদ্ধা দেশনায়ক মানে যেন অর্জুন। শুধুই নিষ্কাম কর্ম করে যাবেন। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা সব কিছুর বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন।’’ বলছেন সুগত।
সুভাষচন্দ্র মানে শুধুই মৃত্যুরহস্য নয়! যদিও জনমানসে নেতাজি বলতে আজ মূলত সেটাই। কৃষ্ণা বসুর আক্ষেপ, ‘‘এর পর ছোটদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সুভাষচন্দ্র কে ছিলেন, সকলে বলবে যাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্য আছে। এর চেয়ে তাঁর কাজ, দেশের প্রতি তাঁর অবদান নিয়ে বরং আলোচনা ভাল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy