Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
এক ফোনেই ভোলবদল

আহতকে নিয়ে মমতার বাড়ি, তবে ভর্তি নিল হাসপাতাল

দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম এক ব্যক্তিকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিটি জায়গাতেই শুনতে হচ্ছে একই কথা— এখানে হবে না, অন্য কোথাও যান। যে হাসপাতালটি একাধিক বার রোগীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কয়েক ঘণ্টা আগেই, সেখানেই এ বার ‘রাজকীয় আয়োজন’। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০৪:৪০
Share: Save:

দৃশ্য ১। দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম এক ব্যক্তিকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিটি জায়গাতেই শুনতে হচ্ছে একই কথা— এখানে হবে না, অন্য কোথাও যান।

দৃশ্য ২। যে হাসপাতালটি একাধিক বার রোগীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল কয়েক ঘণ্টা আগেই, সেখানেই এ বার ‘রাজকীয় আয়োজন’। মুহূর্তে শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

দৃশ্যবদলের নেপথ্যে একটি সিদ্ধান্ত। রোগীকে নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি চলে যাওয়া। খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এসএসকেএম হাসপাতালের সুপারকে নির্দেশ দিলেন রোগীকে ভর্তি নেওয়ার। কিন্তু এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, দাবিদাওয়া যা-ই থাক, রাজ্যের বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল বিশেষ ফেরেনি। দুর্ঘটনায় জখম ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করতেও এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ লাগে।

সোমবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ডায়মন্ড হারবারের নিশ্চিন্তপুরের একটি বিয়েবাড়ি থেকে কয়েক জন যাত্রীকে অটোতে চাপিয়ে ফিরছিলেন চালক পরিতোষ দাস। ডায়মন্ড হারবার রোডে বেলপুকুরের কাছে বাঁশ বোঝাই একটি লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় অটোটির। জখম হন পরিতোষবাবু ও যাত্রীরা। পুলিশ ও স্থানীয়রা মিলে পরিতোষবাবুদের প্রথমে কুলপি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখানে যাত্রীদের প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাঁশের টুকরো গেঁথে বুকের ডান দিকে এবং ডান হাতে গভীর ক্ষত হয় পরিতোষবাবুর। তাঁকে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তবে পরিতোষবাবুর অবস্থা দেখে সেখানকার চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভাল।

এরই মধ্যে খবর পেয়ে ওই হাসপাতালে এসে হাজির হন ডায়মন্ড হারবারের বাটা পেট্রল পাম্প এলাকার বাসিন্দা সমাজকর্মী অমিত রায়। স্থানীয় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে তিনি পরিতোষবাবুকে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ চলে আসেন এসএসকেএম হাসপাতালে।

এর পরেই শুরু হয় হাসপাতালে হাসপাতালে হত্যে দেওয়ার পালা। অমিতবাবুর অভিযোগ, এসএসকেএমের জরুরি বিভাগের পরামর্শে পরিতোষবাবুকে ‘কার্ডিও-থোরাসিক অ্যান্ড ভাসক্যুলার সার্জারি’ (সিটিভিএস) বিভাগে নিয়ে গেলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন রয়েছে বলে ফেরত পাঠানো হয় জরুরি বিভাগে। সেখান থেকে বলা হয়— ‘‘সার্জারি বিভাগে বেড নেই। রোগীকে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যান।’’ চিত্তরঞ্জনে গেলে চিকিৎসকেরা বলেন, রোগীর যা অবস্থা, তাতে সিটিভিএস বিভাগ রয়েছে এমন হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হবে।

অমিতবাবুরা ফের এসএসকেএমে আসেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা তখন বলেন, আউটডোরে দেখাতে গেলে ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে হবে। তত ক্ষণে আউটডোরে রোগীদের লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে। পরিতোষবাবুর বুকের ক্ষত থেকেও ক্রমাগত রক্ত পড়ছে। এই অবস্থা দেখেই রোগীকে নিয়ে কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই সমাজকর্মী।

অ্যাম্বুল্যান্সে করে তাঁরা সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ পৌঁছন কালীঘাটে। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢোকার মুখে অ্যাম্বুল্যান্সটিকে দাঁড় করিয়ে ঘটনাটি অমিতবাবুর থেকে শোনেন পুলিশকর্মীরা। তা জানানো হয় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের। সেখান থেকে অনুমতি মিলতেই অমিতবাবুকে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। অমিতবাবু পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির বাইরের দফতরে। সেখানে মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি সমস্ত কিছু শো‌নার পরে অমিতবাবুকে মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করতে বলেন। অমিতবাবুর কথায়, ‘‘কয়েক মিনিট পরেই ফের আমাকে ডেকে রোগীর নাম এবং আমার ফোন নম্বর লিখে নেন ওই ব্যক্তি। তিনিই আমাকে আবার এসএসকেএমের জরুরি বিভাগে চলে যেতে বলেন।’’

হাসপাতাল সূত্রের খবর, ৯টা ৪০ মিনিট নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং সুপারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এই রোগীর যদি কোনও কিছু হয় তা হলে কেউ পার পাবেন না। যদিও পরে সুপার মানস সরকার ‘আমি কিছু জানি না’ বলেই দায় সেরেছেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে যে হাসপাতাল ওই রোগীকে নিতে টালবাহানা করেছে, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে সেখানে পৌঁছতেই অমিতবাবুরা দেখলেন ‘রাজকীয় আয়োজন’। চিকিৎসকেরা এসে পরিতোষবাবুকে পরীক্ষা করে সিটিভিএস বিভাগে ভর্তি করে নেন। পরে চিকিৎসক শুভঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আঘাত যতটা গুরুতর ভেবেছিলাম, ততটা নয়। চামড়ার নীচের টপ লেভেল টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে যা দরকার, তা করা হয়েছে। আপাতত রোগী অনেকটাই সুস্থ।’’

মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব সময় স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর জোর দেন। তিনি নির্দেশও দিয়েছেন, জরুরি বিভাগে আসা কোনও রোগীকেই ফেরানো যাবে না। সু্প্রিম কোর্টেরও নির্দেশ রয়েছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত কোনও রোগীকে সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল ফেরাতে পারবে না। কিন্তু এই ঘটনা ফের দেখিয়ে দিল, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোর বেহাল অবস্থার শিকড় কতটা গভীরে।

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Victim SSKM Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE