একই আনন্দের রেশ ধূপগুড়ি ও কলকাতায়। নিজস্ব চিত্র
কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে। সময়ের জন্য যে অপেক্ষা করতে হয়, তা সত্যি সত্যি দেখতে পেল ওরা। ২০২০ সালের পুজোর আগে ওদের চোখে, মনে যে আঁধার ছিল, ২০২১-এর দেবীপক্ষে তা নেই। প্রাপ্তি পরিমাণে হয়তো অল্প, কিন্তু হাসি ফোটানোর মাপকাঠিতে অমূল্য। অর্থ দিয়ে যার অর্থ খোঁজা যায় না। পঞ্চমীর সকালে এমন তিন জনের হাসি মুখের কথা শোনা গেল, যাদের মধ্যে দু’জন সহোদর। তৃতীয় জনকে ওরা চেনে না। তবে তিন জনের মধ্যে একটা বড় মিল— আনন্দবাজার অনলাইনে ওদের লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে আসে। আর তার পরেই অন্য দিন। লড়াইয়ের সীমানা পেরিয়ে জীবনের গান গাইছে ওরা।
সদ্য শেষ হওয়া অলিম্পিক্সে কুস্তিতে পদক পেয়েছিল ভারত। গোটা দেশের জয়ীদের নিয়ে আনন্দের সময়েই আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হয় বাংলার ‘দঙ্গল-কন্যা’ শ্বেতা দুবের কথা। কুস্তি লড়তে গেলে বড্ড খিদে পায়। আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলেন শ্বেতা। জানিয়েছিলেন, টানা তিন বার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হলেও অনুশীলন চালিয়ে যেতে এখন অর্থের প্রয়োজন। সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল গত ৬ অগস্ট। শ্বেতা বলেছিলেন, ‘‘কুস্তি লড়তে গেলে অনেক দুধ, ঘি, মাখন খেতে হয়। দিনে কমপক্ষে হাফ ডজন ডিম খাওয়া দরকার। আরও অনেক কিছুই খেতে হয়। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। সত্যি করে বলছি, কুস্তিতে বড্ড খিদে পায়।’’ সেই সঙ্গে একটা চাকরি কেন দরকার তা জানিয়ে শ্বেতা বলেছিলেন, ‘‘আমার বাবা খুবই অসুস্থ। কঠিন রোগে ভুগছেন। তাতেও আমার চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার রোজগার হলে নিজে যেমন কুস্তিতে আরও একটু মন দিতে পারব, তেমনই আমার ছোট যারা কুস্তিকে কেরিয়ার করতে চান, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারব।’’
এই খবর প্রকাশের মিনিট দশেকের মধ্যেই টেলিফোন আসে আনন্দবাজার অনলাইনের দফতরে। এক সংস্থা এক বছরের জন্য শ্বেতাকে বৃত্তি দিতে রাজি। শর্ত ছিল, সংস্থার নাম প্রচার করা যাবে না। খবরটা শুনে ফোনের ওপারে কিছু ক্ষণ চুপ করেছিল শ্বেতা। তারপর বলেছিল, ‘‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’’ এখন শ্বেতা বিশ্বাস করছেন। কারণ, কাগজপত্র তৈরি হতে একটু সময় লাগলেও অগস্টের ৩০ তারিখে প্রথম মাসের বৃত্তি পান শ্বেতা। সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, আপাতত এক বছরের জন্য বৃত্তি দেওয়া হবে শ্বেতাকে। তার পর অবস্থা বুঝে তার মেয়াদ বাড়ানো হবে। কিন্তু ওই সংস্থার কর্তৃপক্ষ চান, কাজের চাপ না নিয়ে যেন আখড়ায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করে কুস্তির অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারেন স্বপ্নদ্রষ্টা কুস্তিগির। তাই ‘বেতন’ নয়। ‘বৃত্তি’। আপাতত একটা বছর কুস্তিতে মন দেওয়ায় কোনও বাধা নেই আর। পঞ্চমীর সকালে শ্বেতা বললেন, ‘‘এ বার পুজো সত্যিই অন্য রকম। এত দিন পুজোর সময় মন খারাপ থাকত। এই প্রথম বার নিজের টাকায় বাবাকে পোশাক কিনে দিয়েছি। অন্যদেরও কিছু কিছু। তবে এই কৃতিত্ব আমার নয়। আঁধারে থাকা আমাকে খুঁজে পাওয়া এবং কষ্টের কথা প্রকাশ করার জন্য সব ধন্যবাদ আনন্দবাজার অনলাইনের প্রাপ্য।’’
শ্বেতা যেমন অসুস্থ বাবার জন্য পোশাক কিনতে পেরে আপ্লুত, ঠিক তেমনই জলপাইগুড়ির দুই ভাই পুজোয় প্রথম বার অনেক উপহার পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। পুজোয় চাই একটা নতুন পোশাক। তাই ধূপগুড়ির ছোট্ট রাজদীপ ফুটপাতে বসে শাক বিক্রি করছিল। এই খবর গত ৮ অক্টোবর, শুক্রবার প্রথম প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার অনলাইনে। তার পর থেকেই ওই খুদের জন্য শুভেচ্ছা ও সাহায্যের একাধিক হাত এগিয়ে আসে। কেউ পুজোয় তাকে নতুন জামা কিনে দিতে চেয়েছেন। কেউ বা আবার নিতে চেয়েছেন তার পড়ার ভার। নতুন জামার জন্য ফুটপাথে শাক বিক্রি করতে বসা রাজদীপের জীবনে এখন উৎসবের আমেজ। আনন্দ আনন্দবাজার অনলাইনেও। কারণ, শ্বেতার মতো রাজদীপের ক্ষেত্রে খবর প্রকাশের পরে পরেই ফোন আসতে শুরু করে। অনেকে আড়ালে থেকে সাহায্যের হাত বাড়াতে আগ্রহ দেখান।
রাজদীপ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। তবে এই বয়সে দারিদ্রকে চেনে ও। বাবা সঞ্জয় তরফদার ফুটপাথে চা বিক্রি করেন। বাড়িতে মা ছাড়া আছেন ঠাকুরমা আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া দাদা সন্দীপ। অভাব এতটাই যে, পুজোর জামা কেনার জন্য রাস্তার ধারে শাক বিক্রি করতে বসে রাজদীপ। কিন্তু মনের গভীরে অনেক ধনী স্বপ্ন। বড় হয়ে চিকিৎসক হতে চায় সে। এখন সেই স্বপ্ন যেন আর দূরের নয় বলে মনে হচ্ছে ওর। খুদের কথায়, ‘‘পুজোর জামা পেয়েছি। অনেক। দাদাও পেয়েছে। এক কাকু বলেছেন, আমার পড়াশোনার খরচ দেবেন।’’
শুক্রবার খবর প্রকাশের পরে রবিবারের মধ্যেই জামার অভাব নেই দুই ভাইয়ের। জামা কিনতে শাক বিক্রি করার খবর আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হতে রাজদীপদের পাশে দাঁড়াতে সহৃদয় মানুষের ঢল নামে। ধূপগুড়ির স্থানীয় বাসিন্দা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের একাধিক শুভাকাঙ্ক্ষী এগিয়ে আসেন। সবাই চান রাজদীপের মুখে হাসি ফুটুক। এই খবর পড়ে ধূপগুড়ির শপিং মলে নিয়ে গিয়ে দুই ভাইকে নতুন জামা কিনে দিয়েছেন কয়েক জন। রাজদীপের বাড়িতে গিয়ে ধূপগুড়ি বারঘরিয়া বিদ্যাশ্রম হাইস্কুলের শিক্ষক অশোকতরু বসু দুই ভাইয়ের হাতে নতুন পোশাক তুলে দিয়েছেন। ধূপগুড়ি হাসপাতালের এক চিকিৎসকও ফুটপাতে বসে শাক বিক্রি করা শিশুটির হাতে নতুন পোশাক উপহার হিসেবে তুলে দেন। এক সঙ্গে এত পেয়ে সত্যিই আনন্দে আত্মহারা দুই ভাই। পঞ্চমীর সকালে রাজদীপের মুখে খুশি দেখে মনে করা কঠিন, তিনটে দিন আগে কচি মুখে ওর সেই আহ্বান, ‘‘নিয়ে যান, কচুর শাক, কুলেখাড়া, লাল শাক, বক ফুল, লাউ শাক, হাতির শুঁড়ের মতো বাঁকানো ঢেঁকি শাক...।’’ রবিবার বলল, ‘‘বড় হয়ে আমি ডাক্তার হতে চাই।’’ বলবে নাই বা কেন! স্বপ্ন সফলের সিঁড়ি তো দেখতে পাচ্ছে সে। উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরের এক বাসিন্দা জানিয়ে দিয়েছেন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত রাজদীপের লেখাপড়ার সব খরচ তিনি দেবেন।
আনন্দবাজার অনলাইনকে ধন্যবাদ জানায়নি খুদে রাজদীপ। অত শত বোঝেই না তো সে। আর এখন তো একটার পর একটা পোশাক গায়ে ফেলে দেখার দিন। তবে ওর ঠাকুমা অনেক আশীর্বাদ দিয়েছেন। প্রবীণা রেখা তরফদার রাজদীপকে প্রচারের আলোয় আনা আনন্দবাজার অনলাইনের সাংবাদিককে বলেন, ‘‘অনেক আশীর্বাদ বাবা। তোমরা এমন গরিব মানুষকে নিয়ে আরও খবর করো। সবার মুখে হাসি ফুটুক। মা দুর্গা মঙ্গল করবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy