বালির বিধায়ক রানা চট্টোপাধ্যায়, বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় ও রায়দিঘির বিধায়ক অলোক জলদাতা।
সকাল থেকেই বেজে যাচ্ছে তাঁদের মোবাইল। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে একের পর এক দায়িত্ব পালন করছেন সদ্য বিধানসভা ভোটে জয়ী নতুন তিন চিকিৎসক বিধায়ক। ভিন্ন জেলা, ভিন্ন কেন্দ্র হলেও, তাঁদের কাজের ধরন মিলে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে। তাঁরা হলেন বালির বিধায়ক রানা চট্টোপাধ্যায়, বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় ও রায়দিঘির বিধায়ক অলোক জলদাতা। মাত্র এক পক্ষকাল আগেই ভোট যুদ্ধে জিতে আরও এক যুদ্ধের সম্মুখীন শাসকদল তৃণমূলের তিন চিকিৎসক জনপ্রতিনিধি। চিকিৎসকের দায়িত্ব অসীম। কিন্তু বিধায়ক হয়ে সেই দায়িত্ব যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে, তা একবাক্যেই মেনে নিচ্ছেন চিকিৎসক ত্রয়ী। তাই এলাকার সাধারণ মানুষকে কোভিড সংক্রমণ থেকে বাঁচানো ও লকডাউনের পরিস্থিতিতে পরিষেবা দেওয়াই এখন তাঁদের গুরুদায়িত্ব।
বসিরহাট দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক হয়েছেন চক্ষু চিকিৎসক সপ্তর্ষি। কিন্তু করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বসিরহাটের মানুষকে বাঁচাতে অনলাইন প্রেসক্রিপশান তৈরি রাখছেন তিনি। কারও প্রয়োজন হলেই তা পাঠানো হচ্ছে অনলাইনে। চিকিৎসা জগতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ বসিরহাট এলাকায় ১৫ শয্যার আইসিইউ, ৫০ শয্যার হাসপাতাল, ২০০ শয্যার সেফ হোম চালু করেছেন। সরকারি বিধিনিষেধ ঘোষণার পর বিধায়কের নির্দেশে স্থানীয় বাজার ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিলি। চারটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করার ব্যবস্থা করেছেন। অনবরত পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সরকারি বিধি এলাকার সঠিক ভাবে পালন হচ্ছে কি না তার খোঁজ নিচ্ছেন ঘণ্টায় ঘণ্টায়। আর অবশ্যই নিজে চিকিৎসক হওয়ার দরুন দায়িত্ব পালনেও সজাগ রয়েছেন সপ্তর্ষি। বসিরহাট দক্ষিণের ডাক্তারবাবু বলছেন, ‘‘এখন সাধারণ মানুষের পক্ষে টাকা খরচ করেও চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমার মোবাইল নম্বর এলাকাবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তাঁরা আমাকে ফোন করলেই, অনলাইনে যেমন প্রেসক্রিপশন পাঠানো হচ্ছে। শরীরিক অবস্থা খারাপ হলে যথা জায়গায় তাঁদের নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর ব্যক্তিগত ভাবে আমার যাঁরা পেশেন্ট রয়েছেন, তাঁদের কথা ভেবেই আমাকে চেম্বারও করতে হচ্ছে।’’
বালির তৃণমূল বিধায়ক রানা চট্টোপাধ্যায় আবার শিশু চিকিৎসক। মাত্র দু’সপ্তাহ আগে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েই কাজ শুরু করেছিলেন পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে। পরিষেবা প্রদানের কাজে নেটমাধ্যমকেও কাজে লাগাচ্ছেন সচেতন নাগরিকের মতোই। ২ তারিখ জয়ের পরদিনই ৩ মে বালি বিধানসভা এলাকার চিকিৎসকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন তিনি। যাঁরা সাধারণ মানুষের অসুস্থতার কথা শুনে টেলি কনসাল্টেশন দিচ্ছেন। ওষুধ দেওয়া, রিপোর্ট দেখা কিংবা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত পরামর্শই চিকিৎসকদলটি দিয়ে চলেছে দিনরাত্রি। বালি, বেলুড় ও লিলুয়া এলাকায় তিনটি পৃথক দল গড়েছেন এই চিকিৎসক বিধায়ক। ১২-১৫ জনকে নিয়ে গঠিত এই দলগুলি করোনা আক্রান্তদের বাড়িতে সবরকম পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।
হাওড়া জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে আরও একটি দল গঠন করা হয়েছে যাঁরা কোভিড আক্রান্তদের সঙ্গে প্রশাসনের যোগাযোগ করিয়ে সরাসরি চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে দিতে পারবেন। নেটমাধ্যমেই এই স্বেচ্ছাসেবকদের নাম, মোবাইল নম্বর দেওয়া হচ্ছে এলাকাবাসী স্বার্থে। বালির লালবাবা কলেজে আগামী মঙ্গলবার একটি অক্সিজেন পার্লারের সূচনা করবেন। বালির বোর্ড অফ এডমিনিস্ট্রেটরস এর সদস্য হিসেবে প্রস্তাব দিয়ে চিকিৎসক-বিধায়ক স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালকে পুরসভার আওতায় এনে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করিয়েছেন। তবে বিধায়কের দায়িত্ব পেয়েও নিজের পেশার প্রতিও দায়বদ্ধ এই শিশু চিকিৎসক। এলাকার অভিভাবকরা তাঁদের শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে নিশ্চিত থাকেন বালির চিকিৎসক বিধায়কের জন্যই। তিনি বলছেন, ‘‘আমি ভোটে দাঁড়ার সময় থেকেই আমাকে প্রচারে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। তাও সত্ত্বেও আমি চেম্বার করেছি। হয়তো সময় কমেছে, কিন্তু আমার উদ্যোগে কোনও খামতি ছিল না। এই ১৪ দিনের বিধায়ক জীবনেও অনলাইন কিংবা অফলাইনে বাচ্চাদের দেখে যাচ্ছি। আমি তো জেনে শুনেই দায়িত্ব নিয়েছি, বিধায়ক হিসেবেও কাজ করতে হবে। চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করতে হবে। কারণ বাচ্চাদের না দেখে আমি কোনওদিনও শান্তিতে থাকতে পারব না। আর আমি জীবনে যা পেয়েছি, যা হয়েছি, তা ওদের জন্যই।’’
সপ্তর্ষি ও রানা রাজনীতিতে নবাগত হলেও, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রায়দিঘির বিধায়ক ডাঃ অলোক জলদাতা। ২০০০ সালে তৎকালীন মথুরাপুরের (বিলুপ্ত) কংগ্রেস বিধায়ক সত্যরঞ্জন বাপুলির সঙ্গে তৃণমূলে যোগ দিলেও, কখনও টিকিট পাওয়ার দৌড়ে ছিলেন না। অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই অলোকের রায়দিঘিতে প্রার্থী হওয়া। বরাবরই ডানপন্থী রাজনীতি করত তাঁর পরিবার। বিধায়ক পদে শপথ নিয়েই রায়দিঘি ফিরেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দিয়ে রায়দিঘি ও মথুরাপুর রুরাল হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের বন্দোবস্ত করেছেন অলোক।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গ্রামীণ এলাকা এ বার প্রভাবিত হয়েছে। তাই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষ যাতে অক্সিজেনের অভাবে মারা না যান, সেই বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগী হন বিধায়ক। কৃষ্ণচন্দ্রপুরে একটি অক্সিজেন পার্লার তৈরি করা। গ্রামীণ হাসপাতালে উপর চাপ কমাতে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মায়াভবনে একটি চার শয্যার একটি অস্থায়ী স্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করিয়েছেন। লালপুর ও কাটামিলিয়ায় অক্সিজেন কনসেনট্রেটরের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নরেন্দ্রপুরের সঙ্গে রায়দিঘি হাসপাতালের দূরত্ব অধিক হওয়ায় সেখানেও অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করেছেন অলোক। জনসচেতনতার জন্য ভোটের সময় নিজের নামের দেওয়াল লিখে মুছে করোনা সচেতনতা নিয়ে দেওয়াল লিখেছেন রায়দিঘির চিকিৎসক বিধায়ক। কোনও রোগী রায়দিঘি থেকে বড় হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে বিধায়ক স্বয়ং সে বিষয়ে উদ্যোগী হচ্ছেন। ভোটে দাঁড়ানোর কারণে ডায়মন্ডহারবার হাসপাতালে থ্যালাসেমিয়া বিভাগের চিকিৎসক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু এই কোভিড সংক্রমণের সময় ফোনেই এলাকাবাসীকে চিকিৎসার পাশাপাশি, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় প্রত্যেক বিধায়ককে এখন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই এই কঠিন সময়ে করোনা বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy