‘‘জানেন মানুষটাকে আমি দাদা পাতিয়েছি। উনি মানুষ নন, ভগবান!’’
ভাঙাচোরা মল্লি বাঁশের বেড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে বললেন বছর কুড়ির তরুণী। শরীরটা এখনও দুর্বল। দিন কয়েক আগে দিল্লির যৌনপল্লি থেকে চাকদহের একতারপুরের বাড়িতে ফিরেছেন তিনি। তবে গোটা পর্বটিতে যাদের তরুণীর পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, তারা কেউই সাহায্য করেনি। বরং পুলিশের কাছে নিখোঁজ ডায়েরি করিয়ে দেওয়ার নামে শাসক দলের স্থানীয় এক নেতা তরুণীর বাবার কাছ থেকে ৭০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ। শেষমেশ নিখোঁজ ডায়েরি হওয়ার পরেও ওই তরুণীকে উদ্ধার করতে চাকদহ থানার পুলিশ তৎপর হয়নি বলেও অভিযোগ মেয়েটির পরিবারের। তরুণী ফিরে আসার পরেও পুলিশ পাচার চক্রের কাউকে ধরতে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
সে জন্যই বোধহয় আরও বেশি করে সেই মানুষটিকে ভগবানের আসন দিচ্ছেন তরুণী, যাঁর সাহায্যে তিনি অন্ধকার দুনিয়া থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। মোবারক হোসেন ওরফে বিট্টু নামে আদতে মালদহের বাসিন্দা ওই যুবক দিল্লিতে গাড়ি চালান। তাঁর এক বাঙালি বন্ধু যৌনপল্লিতে গিয়ে তরুণীর দেখা পেয়েছিলেন। তরুণী ওই যুবককে বাবার ফোন নম্বর দিয়ে সব জানাতে বলেছিলেন। ওই যুবকের কাছ থেকে সবটা জেনে যৌনপল্লিতে গিয়ে তরুণীকে খুঁজে বের করেন মোবারক। তিনিই চাকদহের বাড়িতে ফোন করে দেন। বিট্টুর কথা উঠলেই তরুণীর চোখ দুটো চকচক করে উঠে। বলেন, ‘‘বিশ্বাসই করতে পারবেন না মনুষটা কী ভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছেন।’’
সংসারে অভাবের কারণেই এই তরুণী পড়াশুনো ছেড়ে শ্যামনগরে একটি বাড়িতে বাচ্চার দেখাশোনার কাজ করতেন। মাস কয়েক আগে শ্যামনগর স্টেশনেই এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। পালিয়ে গিয়ে ওই যুবককে বিয়েও করেন তরুণী। স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি। দিন কয়েক হাসনাবাদে ওই যুবকের এক দিদির বাড়িতে থাকার পরেই সোজা দিল্লির যৌনপল্লি। সেখানে তাঁর নাম হয় রবিনা। মোবারক ওই তরুণীর খবর বাড়িতে দেওয়ার পরেও অবশ্য তাঁর ফেরা সহজ হয়নি। কারণ, মেয়েকে দিল্লি থেকে নিয়ে আসার টাকা ছিল না পেশায় ভ্যান চালক তরুণীর বাবার। শেষমেশ এখানে যে পরিবারে তরুণী কাজ করতেন, তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় ‘দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল এইড ফোরাম’-র এর সঙ্গে। মূলত তারাই তরুণীকে বাড়ি ফেরাতে উদ্যোগী হয়। এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেয় কলকাতার আরও এক সংস্থা। তাদের সহায়তায় তরুণীর বাবা এক প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি যান। সেখানে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ওই যৌনপল্লিতে তল্লাশি চালান। কিন্তু তরুণীর সন্ধান তাঁরা পাননি।
ইতিমধ্যে দিল্লি পুলিশের সক্রিয়তা টের পেয়ে ওই তরুণীর হাতে সাড়ে তিনশো টাকা গুঁজে যৌনপল্লি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মহল্লারই এক মহিলা তাঁকে হাওড়ার ট্রেনে তুলে দেন। ট্রেনে আর এক সহযাত্রী যুবকের সাহায্যে তরুণী বাড়িতে যোগাযোগ করেন। তারপর বর্ধমান স্টেশন থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যান তরুণীর পরিজনেরা। অপরিচিত মানুষগুলো যখন এ ভাবে তরুণীকে সাহায্য করল, তখন পুলিশ কেন পারল না, সেই প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। তরুণীর বাবার কথায়, ‘প্রতিবেশী-অত্মীয় থেকে শুরু করে পুলিশ, স্থানীয় নেতা সকলের কাছেই ছুটে গিয়েছিলাম। কেউ সে ভাবে এগিয়ে আসেনি। অথচ ভিন্ রাজ্যে অপিরিচিত লোকজনই এগিয়ে এল মেয়েকে উদ্ধার করতে।’’ ‘দার্জিলিং লিগ্যাল এইড ফোরাম’-এর সাধারণ সম্পাদক অমিত সরকারও মানছেন, ‘‘জেলা পুলিশ নিখোঁজ ডায়েরি পাওয়ার পরে উদ্যোগী হত তাহলে মেয়েটাকে দুর্ভোগ পোহাতে হত না।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘দিল্লি থেকে ফেরার পরে আইনি প্রক্রিয়া শুরুর কোন সুযোগও পুলিশ মেয়েটিকে দেয়নি। অপরাধীদের ধরতেও তৎপর হয়নি।’’ নদিয়ার জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ অবশ্য বলেন, ‘‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। উপযুক্ত পদক্ষেপ করা হবে।’’
পুলিশের উপর অবশ্য ভরসা নেই তরুণীর। তবে যাঁর জন্য তিনি ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন, সেই মোবারককে ভাইফোঁটা দিতে চান। মোবারকও বলছেন, ‘‘যাব, নিশ্চয়ই যাব। বহেন যখন ডেকেছে, তখন যেতে তো হবেই।’’ কেন জীবন বাজি রেখে ওই মহল্লা থেকে বের করে এনেছিলেন ‘রবিনা’কে? মোবারকের জবাব, ‘‘বন্ধুর কাছ থেকে সব শুনে মেয়েটার জন্য খুব মায়া হল। নিজের বোনটার কথা মনে পড়ল।’’ দাদা বোন দু’জনেই এখন ভাইফোঁটার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy