প্রাচীন মায়াপুরের জন্মস্থান আশ্রম। —নিজস্ব চিত্র।
নবদ্বীপ: শুধুই কোনও স্থান নাম নয়। স্থান মাহাত্ম্যে এই ভূখণ্ড অতুলনীয়। ইতিহাসের নানা কর্মকাণ্ডের সাক্ষী এই শহর। আর এই ভূখন্ডেই জন্মেছিলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। চৈতন্যর অর্ধেক জীবন কেটেছে এখানে। আগমবাগীশ সংকলন করেছেন বৃহত্তন্ত্রসার, রঘুনাথ শিরোমণি নির্মাণ করেছেন নব্যন্যায়, পাশাপাশি এই গঙ্গার তীরেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গড়ে তুলেছেন সমকালীন বৃহত্ বঙ্গের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রটি।
পর্যটক আকর্ষণের এমন ষোড়শোপচার আয়োজন বড় একটা চোখে পড়ে না। তা সত্ত্বেও নবদ্বীপে গড়ে ওঠেনি কোনও সুসংবদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র। উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং পরিকল্পনার অভাব এই দু’য়ে মিলে ক্ষেত্র তৈরি থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে সে ভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি নবদ্বীপ। এই অভিমত দেশি-বিদেশি পর্যটক থেকে ইতিহাস পুরাতত্ত্বের গবেষক কিংবা স্থানীয় ব্যবসায়ী মহল থেকে সাধারণ মানুষ সকলেরই।
অথচ প্রায় সারা বছর ধরেই নবদ্বীপে পর্যটকের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাঁদের কেউ আমদাবাদ থেকে আসেন তো কেউ আমেরিকা থেকে আসেন। দোল, রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, গাজন, চড়ক নবদ্বীপে উত্সবের শেষ নেই। অন্ত নেই মানুষের যাতায়াতেরও। গঙ্গার পশ্চিমপাড়ের নবদ্বীপ এবং পূর্বপাড়ের মায়াপুরকে নিয়ে যমজ পর্যটন কেন্দ্র ঠিক মতো গড়ে তুলতে পারলে এলাকার অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে বলে মনে করেন সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে অর্থনীতির অধ্যাপক। আর সে কাজে সবার আগে দরকার একটা বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা। তাকে বাস্তবায়িত করে তুলতে সরকার প্রশাসন এবং ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান দরকার।
অন্য পরিচয়ের সঙ্গে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও নবদ্বীপের পরিচিতি বহু প্রাচীন। ইতিহাস, চৈতন্যজীবনী বা মঙ্গলকাব্য থেকে জানা যায় বস্ত্র, কাঁসা পিতলের বাসন এবং শঙ্খশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল নবদ্বীপ। পরবর্তীতে তাঁতের শাড়ি এবং নবদ্বীপ তাঁত কাপড়ের হাট সুদীর্ঘ কাল ধরে নবদ্বীপের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। একটা সময় ছিল গোটা পূর্ব ভারতে তাঁতের শাড়ির পাইকারি ব্যবসা নবদ্বীপ কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু এখন সে সব অতীত। আটের দশক থেকে সাগরপারের কৃষ্ণ ভক্তেরা দলে দলে মায়াপুরের ইস্কনে আসা শুরু করতেই স্থানীয় অর্থনীতির পালে নতুন বাতাস লাগতে শুরু করে। পরবর্তী সিকি শতাব্দী ধরে তাঁরা গঙ্গা পেরিয়ে পশ্চিম পাড়ে এসেছেন। চৈতন্য জন্মভুমি নবদ্বীপে মঠ-মন্দির-বসতি গড়েছেন। তাঁদের হাত ধরে একটু একটু করে বদলে গেছে প্রাচীন নবদ্বীপের উত্সব অনুষ্ঠানের খোলনলচে। বিশ্বের বৈষ্ণবদের অন্যতম গন্তব্য এখন নবদ্বীপ ধাম। স্বাভাবিক ভাবেই ক্রমশ পর্যটন নির্ভর হয়ে পড়েছে নবদ্বীপ।
নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক উত্তম সাহা বলেন, এ শহরের অর্থনীতির অনেকটাই এখন পর্যটন নির্ভর। বাণিজ্যিক ভাবে দোল এখন নবদ্বীপের প্রধান অর্থকরী উত্সব। তারপর আসবে রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমী এবং বিভিন্ন মঠমন্দিরের বারো মাসের নানা নিজস্ব উত্সব। ফলে শহরে এখন বছরভর লোক সমাগম। যাঁদের একটা বড় অংশ বিদেশি। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেই এইসব উত্সব থেকে বাণিজ্যের সুযোগ পান। বিশেষ করে খুচরো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পর্যটন থেকে নবদ্বীপের আরও অনেক পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, ততটা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদকের মতে অনেক কিছুই হয়েছে শহরে। কিন্তু এখনও বাকি অনেক কিছু।
নবদ্বীপ নাগরিক কমিটির মতে পর্যটনের স্বার্থে শহরের রাস্তাঘাট এবং যানবাহনের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। এই কমিটির সম্পাদক দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এত মানুষ নবদ্বীপে আসেন, তাঁদের জন্য যানজটহীন যাতায়াতের ব্যবস্থা আগে দরকার।” তিনি জানান, পুরানো ঘিঞ্জি শহরকে হয়তো পাল্টানো যাবে না। কিন্তু সংকীর্ণ পথঘাট যতটা সম্ভব দখলমুক্ত এবং যানজট মুক্ত রাখা, নিয়মিত রাস্তা সংস্কার করা এবং রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে সবার আগে নজর দিতে হবে। কেননা একজন বহিরাগত পর্যটকের কাছে এই ক’টি জিনিস সবার আগে গুরুত্ব পায়। গুরুত্ব দিতে হবে শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণে। তাদের ভাড়ার হার নির্দিষ্ট করে দেওয়া, রুট ঠিক করে দেওয়া, বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের স্থায়ী স্ট্যান্ড করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এবং উত্সবের সময় লাখো মানুষের ভিড়ে ঠাসা শহরের পথঘাট যাতে যানজট মুক্ত থাকে তাঁর জন্য একটা সামগ্রিক যান নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত পথকে একমুখী করতে হবে।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নবদ্বীপকে আলাদা করে পরিচিত করানোর দরকার পড়ে না।” তিনি জানান, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই শহর বিশ্ব জুড়ে চর্চিত। একদিকে ন্যায়, তন্ত্র, বৈষ্ণবদর্শন অন্যদিকে বাণিজ্য বা আরও আগে বাংলার শেষ স্বাধীন রাজার রাজধানী বা বৌদ্ধদের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নবদ্বীপ সকলের কাছে আকর্ষণীয়। দরকার শুধু সরকারি সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন পরিকাঠামো গড়ে তোলা। তাঁর মতে সবার আগে নবদ্বীপে প্রয়োজন এক বা একাধিক সরকারি অতিথিশালা। যেখানে এসে উচ্চ, মধ্য এবং নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁদের সাধ্য মতো সুস্থ, ঘরোয়া পরিবেশে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। যাঁরা গাড়ি আনবেন তাঁদের গাড়ি, ড্রাইভার থাকার ব্যবস্থা-সহ আধুনিক গেস্ট হাউস সবার আগে দরকার। সঙ্গে শহরের প্রধান দ্রষ্টব্য স্থানগুলি বেছে নেওয়া এবং পর্যটকেরা যাতে সেই স্থানগুলি ঠিক মতো দেখতে পারেন সেজন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং স্টেশন, খেয়াঘাট, বাসস্ট্যান্ডে ফ্লেক্স বা বোর্ডে স্থানগুলির নাম, কোথায় অবস্থিত, ভাড়া প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য দেওয়া দরকার যাতে বহিরাগতদের কোনও ভাবে বিভ্রান্ত হতে না হয়।
নবদ্বীপের বিধায়ক তথা রাজ্যের জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তরের মন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা বলেন, “পর্যটনের বহু প্রাচীন কেন্দ্র নবদ্বীপকে আধুনিক সাজে সাজিয়ে তোলার জন্য আমরা ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ করেছি।” তিনি জানান, পিএইচই দফতর এখানে একটি উন্নতমানের আবাস তৈরি করেছেন। গোটা শহরের বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থা ভূগর্ভস্থ হচ্ছে। এজন্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। বর্ষার পরেই কাজ শুরু হবে। চেষ্টা চলছে এ বারের রাসের আগে কতটা বেশি কাজ করা যায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই নবদ্বীপকে সাজানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, শহরে দূষণহীন ব্যাটারি রিকশা চালু হয়েছে। নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরে একটি বড় মাপের যুব আবাস তৈরি হচ্ছে, যা শহরের অতিথিশালার অভাব অনেকটাই মেটাতে সক্ষম হবে। গঙ্গার তীরের সৌন্দর্যায়নের কাজও শুরু হবে।
নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধায়ের মতে, “খুব কম জায়গাতেই ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক সব ধরনের উপাদানের এমন প্রাচুর্য দেখা যায়।” তাঁর কথায়, বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন, বখতিয়ার খলজি, চৈতন্য মহাপ্রভু, আগমবাগীশ, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মতো বহুবর্ণের ঐতিহাসিক চরিত্র সমাবেশ আর কোথায়? নবদ্বীপ মানেই পুনরুজ্জীবন। কখনও তা বৃহত্তন্ত্রসারে প্রকাশিত কিম্বা নব্যন্যায়ে প্রতিফলিত। বুদ্ধদেব বাবুর মতে, নবদ্বীপকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড না বলে অক্সফোর্ডকে পাশ্চাত্যের নবদ্বীপ বলা উচিত। নবদ্বীপ নিজেই এক জীবন্ত ইতিহাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy