খোলা আকাশের নিচে মুক্তমঞ্চই ভরসা শহরের শিল্পীদের। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি ।
কান্দির রাজাদের কল্যাণে বাঙালি পেয়েছে নাট্যকার মধুসূদন দত্তকে। কান্দির রাজাদের কল্যাণে ১৮৫৯ সালে কলকাতা পেয়েছিল ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’ যার আর একটি নাম ‘বেলগাছিয়া থিয়েটার’। সেই কান্দিতেই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য উপযুক্ত মঞ্চ বা প্রেক্ষাগৃহ আজও গড়ে ওঠেনি। যে টুকু গড়ে উঠেছিল তাও ‘জবরদখল’ করেছে কান্দি পুরসভা। ফলে প্রেক্ষাগৃহের দাবিতে ১৬টি সাংস্কৃতিক সংস্থা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘কান্দি সংস্কৃতি সমন্বয় কমিটি’ নামে যৌথ মঞ্চ। প্রেক্ষাগৃহের দাবিতে ওই ‘সমন্বয় কমিটি’ দু’দশক ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও পুরসভা বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রেক্ষাগৃহের বিষয়ে কোনও রকম হেলদোল নেই। অথচ প্রায় দেড়শো বছর আগে এই শহরেরই নাট্যমন্দিরের উদ্বোধন করতে কান্দিতে এসেছিলেন বিদ্যাসাগর স্বয়ং।
কান্দির রাজাদের কলকাতার পাইকপাড়াতেও রাজবাড়ি আছে। তাই তাঁদের একই সঙ্গে বলা হয় পাইকপাড়ার রাজা ও কান্দির রাজা। ১৮৬৯ সালে কান্দি পুরসভার প্রতিষ্ঠা। তারও ১১ বছর আগের কথা। তখন পাইকপাড়ার রাজা ছিলেন দুই ভাই—প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ। দুই রাজভ্রাতার উদ্যোগে ১৮৫৮ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’। ওই নাট্যশালায় প্রথম মঞ্চস্থ হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের নাটক ‘রত্নাবলি’। এ কথা জানিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক সায়ন্তন মজুমদার বলেন, “ইংরেজ সাহেবদের প্রয়োজনে রত্নাবলির ইংরাজিতে অনুবাদ করার জন্য পাইকপাড়ার রাজাদের কাছ থেকে মহাকবি মধুসূদনের কাছে অনুরোধ পৌঁছয়। নাটক হিসাবে রত্নাবলির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি অনুবাদ করতে অসম্মত হন।”
এ বার প্রশ্ন উঠে, তা হলে উন্নতমানের নাটক কে লিখবে? সায়ন্তন বলেন, মধুসূদন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। লিখলেন নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। পাইকপাড়ার রাজাদের আনুকূল্যে ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রন্থাকারে ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হয়। তার ৮ মাস পরে সেপ্টেম্বরে ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’য় ‘শর্মিষ্ঠা’র প্রথম প্রযোজনা। ওই দিন দর্শক ছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর। বেলগাছিয়ার পাশাপাশি কান্দিতেও ১৮৫৯ সালে প্রতাপচন্দ্র সিংহ ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন নাটমন্দির। সেই নাটমন্দির উদ্বোধন করে বিদ্যাসাগর ওই দুই রাজভ্রাতার উদ্দেশে জানান, নাটমন্দিরের বদলে বিদ্যামন্দির করলে আরও ভাল হয়। কান্দির রাজারা বছর খানেক পর বিদ্যাসাগরের ইচ্ছাপূরণ করেন। ওই নাটমন্দিরকে তাঁরা বিদ্যালয় ভবনে রূপান্তরিত করেন। কান্দি রাজস্কুলের ওই ভবনের গায়ে আজও সমুজ্জ্বল রয়েছে ‘বিদ্যাসাগর ভবন’ লেখাটি।
কান্দির রাজাদের মতোই নাট্যামোদী ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ছোটলাট লর্ড হ্যালিফক্স। তিনি এক বার মুর্শিদাবাদে এসে কান্দি, রঘুনাথগঞ্জ ও আজিমগঞ্জ পরিদর্শন করেন। তাঁর সেই ভ্রমণ স্মৃতি অটুট রাখতে ওই তিনটি জায়গাতেই গড়া হয় ‘হ্যালিফক্স ময়দান’ ও ‘হ্যালিফক্স হল’। কান্দির হ্যালিফক্স ময়দান লাগোয়া হ্যালিফক্স হল আসলে মাথার উপরে ছাদ-সহ একটি বড়সড় চাতাল। প্রায় আড়াইশো লোক বসার মতো ওই চাতালের দু’দিকে ঘেঁষাঘেষি করে রয়েছে ছোট আকারের কয়েকটি ঘর। আর এক দিকে রয়েছে একটি মঞ্চের মতো বেদি। কিন্তু তাতে আলো ও শব্দের কোনও ব্যবস্থা নেই। সেই হ্যালিফক্স হলেই একদা অনুষ্ঠিত হত কান্দির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১৯৬৬ সালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে করে নিয়ে এসে কান্দিতে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেছেন স্বয়ং শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই হ্যালিফক্স হল ও ঘরগুলি এখন পুরসভার দখলে। ঘরগুলি এখন পুরসভার কার্যালয়।
১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রাজ্যের প্রতিটি মহকুমা শহরে একটি করে রবীন্দ্রভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই মতো কান্দিতেও রবীন্দ্রভবন নামে একটি বড় ঘর ও একটি বারান্দা নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে না আছে মঞ্চ, না আছে বসার আসন। কান্দির নাট্যসংস্থা রাখালিয়ার অন্যতম কর্ণধার অপরেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অসম্পূর্ণ ওই ভবনটি এখন পুরসভার দখলে। কখনও পুরসভার গুদামঘর হিসাবে, কখনও জন্মমৃত্যুর শংসাপত্র বিলি করার কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করা হয়।” কান্দির ‘কোরাস’ নাট্যসংস্থার আশিস পাত্র বলেন, “রবীন্দ্রভবনটি কান্দি পুরসভার দখলে থাকলেও মালিকানা নিয়ে পুরসভার সঙ্গে সাধারণ পাঠাগারের মামলা চলছে।” বিজ্ঞানসম্মত ও যথাযথ একটি প্রেক্ষাগৃহের অভাব পূরণ করতে কান্দি শহরে জেলাপরিষদের তত্ত্বাবধানে প্রায় এক দশক ধরে নির্মীয়মান একটি ভবনের কথা বলা হয়ে থাকে হামেশাই। কংগ্রেসের দখলে থাকা কান্দির পুরপ্রধান গৌতম রায় বলেন, “জেলাপরিষদের উদ্যোগে নির্মীয়মান অডিটোরিয়ামে সাংস্কৃতিক মঞ্চ ছাড়াও থাকছে পঞ্চায়েতের কর্মশালা কক্ষ। অডিটোরিয়াম নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ হলে কান্দির প্রেক্ষাগৃহের অভাব মিটবে।”
সেই অডিটোরিয়ম নির্মাণের কাজ কবে শেষ হবে তাই নিয়েই কান্দির আমজনতা থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী পর্যন্ত সবার মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। ‘কান্দি সাংস্কৃতিক সমন্বয় কমিটি’র অন্যতম কর্মকর্তা শ্রীকান্ত দাস বলেন, “এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জেলাপরিষদের ওই অডিটোরিয়াম নির্মাণের কাজ চলছে। কবে শেষ হবে কেউ জানে না। শহরে কোনও প্রেক্ষাগৃহ না থাকার ফলে শহরের সংস্কিৃত চর্চা ব্যাহত হচ্ছে।” নির্মীয়মান ওই প্রেক্ষাগৃহের গুণমান নিয়েও ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ‘কান্দি সাংস্কৃতিক সমন্বয় কমিটি’র অন্যতম কর্ণধার অপরেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “নাট্যকর্মী-সহ সাংস্কৃতিক জগতের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে ওই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করায় কতটা বিজ্ঞান সম্মত হবে ওই প্রেক্ষাগৃহ, তা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আলো প্রক্ষেপণ, শব্দ ব্যবস্থা ও বসার আসন নিয়ে ভবিষ্যতে ভোগান্তি রয়েছে।”
স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ ও মঞ্চ না থাকলেও কান্দির নাট্যকর্মীদের আবেগের কাছে হার মেনেছ সেই অভাব ও অব্যবস্থা। বরাবরের মতো এ বারও শীতের আমেজ গায়ে মেখে অতি সম্প্রতি তিন তিনটে নাট্যোৎসব করল কান্দি। কান্দির হ্যালিফক্স ময়দানের মুক্তমঞ্চে তিনটি নাট্যোৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তমঞ্চের উপর অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে মাথার উপর সামিয়ানা খাটিয়ে অন্য বছরের মতো এ বার উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘ঝড়’ নাট্যগোষ্ঠীর ৭ দিনের নাট্যোসব হয়েছে। সেখানেই গত ২১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ দিনের নাট্যমেলা করে ‘রাখালিয়া’ নাট্যসংস্থা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ দিনের নাট্যোৎসব করে কান্দির নাট্যদল ‘কোরাস’। সেই সব নাট্যোৎসব গুলিতে বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন রাজ্যের, এমনকি বিদেশের নাট্যদলও অংশগ্রহণ করে। আর তাতেই মাথা কাটা যায় কান্দির নাট্যদল গুলির। কান্দির এক নাট্যকর্মী বলেন, “আজও কান্দিতে নাটক মঞ্চস্থ করার মতো উপযুক্ত স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ নেই কেন? বহিরাগত নাট্যদলের ওই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা যায়। লজ্জা পায় না কেবল প্রশাসন ও পুরসভা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy