“মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি’’— বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপটি কি কৃষ্ণনগর শহরের বুকে চাঞ্চল্য ছড়াচ্ছে?
আশঙ্কা করছেন খোদ পুলিশকর্তারাই। দুষ্কৃতীদের লাল চোখ এড়িয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ইন্দ্রনীল রায়ের হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিতে সাহস করছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা।
গত বছর ২০ আগস্ট দাদুর বাৎসরিক শ্রাদ্ধে যোগ দিতে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মেধাবী ছাত্র ইন্দ্রনীল। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে রিকশায় ফিরছিলেন। বেলেডাঙা মোড়ের কাছে আসতেই দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলি লাগে তার তলপেটে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তাঁর।
ভর সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগরের বেলেডাঙার মত একটি জনবহুল এলাকায় চোখের সামনে ইন্দ্রনীলকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছিলেন অনেকেই। প্রকাশ্যে না হলেও এদিক ওদিক ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেনও তাঁরা। কিন্তু আদালতে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা নেই তাঁদের কারও। এমনকী পুলিশ যে সামান্য কয়েকজনের নাম সাক্ষী হিসাবে রেখেছে তারাও যে শেষ পর্যন্ত আদালতে দাঁড়িয়ে কী সাক্ষ্য দেবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ পুলিশ মহলেই।
জেলা পুলিশের কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে অভিযুক্তরা না নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে যায়। জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “এই মামলার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার সঙ্গে যুক্তদের পুলিশ গ্রেফতার করলেও, তেমন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী পুলিশ জোগাড় করতেই পারেনি।”
অথচ সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েক জন ব্যবসায়ী বা সাধারণ মানুষকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। যাঁরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের নানা ভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে পুলিশ কর্তারা। কিন্তু তাতেও কেউ সাক্ষী দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না বলে দাবি পুলিশের।
জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “ছাত্র খুনের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা বাড়াতে পারলে মামলা শক্তিশালী হত। কিন্তু কোনও ভাবেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সেই সময় ঘটনাস্থলে এত লোকজন ছিল অথচ সাক্ষী দেওয়ার বেলায় কেউ এগিয়ে আসছেন না।’’
কিন্তু কেন এমটা হচ্ছে? পুলিশ সুপার নিজেই বলেন, “এই ঘটনায় যারা ধরা পড়েছে, তাদের দেখেই সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছে মানুষ।”
ইন্দ্রনীল হত্যার ঘটনায় যে দু’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে সেই মিঠুন চক্রবর্তী ও বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ওরফে চিমার বিরুদ্ধে একাধিক অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের খাতায়। বিশেষত খুন, ছিনতাই, তোলাবাজিতে বেলেডাঙা এলাকার ত্রাস হিসেবেই পরিচিত এরা। পুলিশের কাছে ‘নটোরিয়াস ক্রিমিনাল’।
ফলে শহরের ব্যবসায়ীরা ভয়ে কেউই সাক্ষী দিতে রাজি হচ্ছেন না। একই কথা জানিয়েছেন কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা। তিনি বলেন, “আমি নিজে উদ্যোগী হয়েছিলাম ওই ছাত্র খুনের ঘটনায় সাক্ষী জোগাড় করার বিষয়ে। বেশ কয়েক জনের সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। কিন্তু কেউই রাজি হননি।”
অসীমবাবুর বক্তব্য এলাকার মানুষ এতটাই আতঙ্কিত যে তাঁরা কেউই এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছেন না। বিশেষত তাঁদের ভয় কোনও ভাবে যদি ধৃতরা জামিন পেয়ে যায়। তবে বিপদ বাড়বে।
এমনকী ধৃতদের জামিনের ভয়ে সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকেই অন্যত্র বাড়ি ভাড়া খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিলেন বলে জানাচ্ছেন এলাকার কেউ কেউ।
অথচ মৃত্যুর আগে পুলিশের উপর আস্থা রেখেছিলেন ইন্দ্রনীল। মায়ের কাছে অস্ফুটে তিনি বলেছিলেন পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে। তদন্তে নেমে পুলিশ অবশ্য দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। শুধু তাই নয় শহরের আরও বেশ কয়েক জন দুষ্কৃতীকেও গ্রেফতার করা হয় সে সময়। কিন্তু সে সব মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দূর করতে পারেনি।
যাঁরা গ্রেফতার হয়েছে তারা তো একদিন ছাড়া পাবেই। তখন আমাদের কে রক্ষা করবে?—এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে এলাকার বাসিন্দাদের মুখে। তাছাড়া গোপনে অনেকেই বলছেন, সে দিনের অপরাধীরা সকলেই গ্রেফতার হয়নি। মাথাদের শাগরেদরা বহাল তবিয়ৎ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে। ফলে সাক্ষী দিয়ে বাড়ি ফেরার পরে নিশ্চিত তাদের হামলার মুখে পড়তে হবে।
বেলেডাঙা বাজার, গোরুর হাটের তোলাবাজির বখরা নিয়ে এলাকার দুষ্কৃতীদের সংঘর্ষে এর আগেও প্রাণ গিয়েছে বেশ কয়েকজনের। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি তো স্বাভাবিক হয়নি বরং গোটা এলাকা দুষ্কৃতীদের এক প্রকার মুক্তাঞ্চালে পরিণত হয়েছে। যাঁর ফলে ভর সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছে নিরীহ এক ছাত্রকে।
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন কুখ্যাত দুষ্কৃতী পরিতোষ দাস বা হাতকাটা পরী রহস্যজনক ভাবে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার পরে থেকেই এলাকার দখল নিয়ে শাগরেদদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। নিতাই দাস ও ব্যাঙা সিংহের দু’টি গোষ্ঠীর সংঘর্ষে শহরবাসির ওষ্ঠাগত প্রাণ। এরই মধ্যে আবার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নিতাইয়েরই দুই সাগরেদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়।
পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, ঘটনার দিন মিঠুন চক্রবর্তী তার ঘনিষ্ট চিমাকে চড়াও হয় তারই দলেই সুদেবের উপর। সেই ‘গ্যাং ওয়ারের’ মধ্যে পড়েই গুলিবিদ্ধ হন মেধাবী ছাত্র ইন্দ্রনীল। সেই সময় এলাকার বাসিন্দারা চরম ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ্য কেউই মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে খুনিরা আদৌ শাস্তি পাবে কিনা তা নিয়েই সংশয়।
জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “মৃত্যুর আগেও আমাদের উপর আস্থা রেখেছিলেন ইন্দ্রনীল। আমরাও সব রকম ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে খুনিরা সাজা পায়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।”
এ দিকে নিহত ছাত্রের বাবা কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা গৌতম রায় বলেন, “আমার নিষ্পাপ ছেলেটা কোনও অন্যায় না করেই অকালে ঝরে গেল। আরও অনেক সন্তানের জীবনের স্বার্থে নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি। না হলে অপরাধীদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। বাড়বে বিপন্নতা।” কিন্তু ঠিক কতটা সাড়া মিলবে গৌতমবাবুর কাতর আবেদন? উত্তর খুঁজবে সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy