ওরা কাজ করে। ছবি:অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
ম্যাটাডরের উপরে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ছেন প্রার্থী। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মাথায় তোয়ালে। গনগনে দুপুরে আস্তে আস্তে কাশিমনগরের দিকে এগিয়ে চলেছে ম্যাটাডর। পিছনে শ’দুয়েক মোটরবাইক। কর্মী-সমর্থকদের ঘন ঘন স্লোগান। অথচ এই বিশাল মিছিলের স্লোগান কিংবা বাইকের আওয়াজ যেন কোনওটাই কানে গেল না তাঁদের। বিড়ি বাঁধতে বাঁধতেই একজন জানতে চাইলেন, “কারা গেল রে?” উত্তরটা এল আরও নির্লিপ্ত ভাবে, “তৃণমূল।”
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে একই কায়দায় বিড়ি মহল্লা বলে পরিচিত অরঙ্গাবাদ এলাকা দিয়ে মিছিল করে গিয়েছে সিপিএম ও কংগ্রেসের প্রার্থীও। কিন্তু ভোট নিয়ে যেন এবার সেভাবে কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছেন না বিড়ি শ্রমিকরা। জঙ্গিপুরের ১৩ লক্ষ ৮৭ হাজার ভোটারের মধ্যে বিড়ি শ্রমিকদের সংখ্যা লাখ ছয়েকের উপর। আর মাত্র সপ্তাহ তিনেক পরেই ভোট। অথচ ভোট নিয়ে এমনই নিরুত্তাপ বিড়ি শিল্প নগর অরঙ্গাবাদ। সেভাবে উৎসাহ চোখে পড়ছে না ধুলিয়ান ও ফরাক্কাতেও। জঙ্গিপুর মহকুমার বিড়ি শিল্পের এই দুই শহর অবশ্য মালদহ দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
ভোট এলেই বিড়ি শ্রমিকদের সমর্থন পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এলাকা ঘুরে প্রচার সেরে গিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব কায়দায় প্রচার করে গিয়েছেন সিপিএমের মুজাফ্ফর হোসেন। রবিবার, ছুটির দিনে বিড়ি মহল্লা ঘুরে গেলেন তৃণমুল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলামও।
কিন্তু ভোট নিয়ে বিড়ি শিল্পাঞ্চলের এমন মেজাজ আগে কখনও দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না বহু পোড় খাওয়া রাজনীতির কারবারিরাও। ২০০৯ এবং ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনেও এই বিড়ি শ্রমিক মহল্লাগুলি ছিল রীতিমতো সরগরম। সন্ধ্যা হলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকা কিংবা ফেস্টুন নিয়ে ছোট ছোট মিছিল বেরোত পাড়াতেই।
কিন্তু এবার পাড়াতে মিছিল তো দূরের কথা, পাড়া দিয়ে বড় মিছিল গেলেও থম মেরে থাকছে বিড়ি মহল্লা। কেন? বামুহা গ্রামের মেহেরুন্নেসা বিবি বলছেন, “ভোট তো এখন পরব গো। ফি বছরই আসে। আবার চলেও যায়। আমরাও বহু আশা নিয়ে ভোট দিয়ে আসি আর ভাবিএ বার বুঝি আঁধার কাটবে। কিন্তু কই, কিছুই তো হল না।” মেহেরুন্নেসা বলেন, “স্বামী-স্ত্রী মিলে হাজার দেড়েক বিড়ি বাঁধি। দেড়শো টাকা আয় হয়। এই টাকায় ছেলেমেয়ে নিয়ে ছ’জনের সংসার যে কী ভাবে চলে তা আমরাই জানি। এখনও সরকারি ন্যূনতম মজুরি চালু হল না। প্রথম দিকে ভাবতাম, ভোট দিলে হয়তো মজুরিটা বাড়বে। এখন সে আশা ছেড়ে দিয়েছি। তাই স্বামীকেও বলে দিয়েছি মিছিল মিটিং না করে বাড়িতে থাকলে আরও কিছু বেশি বিড়ি বাঁধা যাবে।”
ভোটের কথা উঠতেই তেনাউড়ির সামাদ শেখের গলাটা যেন ঈষৎ রুক্ষ হয়ে যায়, “কী আর হবে ওসব করে? যারা গুছিয়ে নেওয়ার তারা ঠিক গুছিয়ে নিয়েছে। আমাদের কথা কেউই ভাবল না। ওরা সবাই সমান। তাই ভোট ফোট নিয়ে আমরাও আর ভাবছি না।” হেনা বেওয়া বলছেন, “অত বড় মিছিলটা গেল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওই মিছিলে কোনও বিড়ি শ্রমিক খুঁজে পাবেন না। একটা সময় ৩ টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য ছেলেরা পুলিশের লাঠি খেয়েছে, জেলে গিয়েছে। তারপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে কত জল বয়ে গেল, আমাদের কথা তো কেউ ভাবল না!”
বিড়ি শ্রমিকদের এই বঞ্চনার কথা কবুল করছেন বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও। জঙ্গিপুর কেন্দ্রের সিপিএমের প্রার্থী মুজাফফর হোসেন বলছেন, “বিড়ি মালিকদের শোষণের শিকার হতভাগ্য বিড়ি শ্রমিকেরা। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করেনি। তাছাড়া বিড়ি মালিকেরা এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না।” কংগ্রেসের বিড়ি সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, “বিড়ি শ্রমিকরা ভেবেছিলেন যে, এলাকায় বিকল্প শিল্প গড়ে উঠবে। তাতে সুদিন ফিরবে। কিন্তু তা হয়নি। হয়তো সেই কারণেই ভোট-রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইছেন তাঁরা।” তৃণমুলের শ্রমিক সংগঠনের নেতা সোমেন পাণ্ডে বলছেন, “দীর্ঘদিন রাজ্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকেছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। বিড়ি মালিকদের হাতের পুতুল হয়ে থেকেছে ওই দলগুলো। আর সেই কারণেই এতদিনেও সরকারি ন্যূনতম মজুরিটাও চালু করতে পারেনি তারা। তাই ভোট নিয়ে যদি শ্রমিকদের উৎসাহ না থাকে দোষটা কোথায়?”
সকলেই ব্যস্ত একে অন্যের উপরে দায় চাপাতে। সকলেই মানছেন, ভাল নেই বিড়ি মহল্লা। কিন্তু তাঁদের জন্য কেউ কি কিছু করছেন? তাঁদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করার জন্য কোনও দলই কি কিছু ভাবছে? উত্তর মেলে না। মিছিলটা এগোতে এগোতে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যায়। মিলিয়ে যায় স্লোগান কিংবা বাইকের আওয়াজও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy