Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

বাংলার পর্যটন মানচিত্রে ব্রাত্য শান্তিপুর

সন্ন্যাস গ্রহণের পরে গঙ্গা পেরিয়ে প্রথম শান্তিপুরেই এসেছিলেন চৈতন্য। গঙ্গাপাড় ও তা ছাড়িয়ে তাবত্‌ বাংলার লোক সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেই সমাবেশই চৈতন্যকেন্দ্রীক প্রথম জনসংঘট্ট বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। মুণ্ডিতমস্তক ঊর্ধ্ববাহু নৃত্যরত চৈতন্যের যে বিগ্রহ পরের পাঁচশো বছরে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তার প্রথম দর্শন মিলেছিল এই শহরেই অদ্বৈতাচার্যের বাড়িতে।

শান্তিপুরে শ্যামচাঁদ মন্দির।

শান্তিপুরে শ্যামচাঁদ মন্দির।

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:২৪
Share: Save:

সন্ন্যাস গ্রহণের পরে গঙ্গা পেরিয়ে প্রথম শান্তিপুরেই এসেছিলেন চৈতন্য। গঙ্গাপাড় ও তা ছাড়িয়ে তাবত্‌ বাংলার লোক সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। সেই সমাবেশই চৈতন্যকেন্দ্রীক প্রথম জনসংঘট্ট বলে মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। মুণ্ডিতমস্তক ঊর্ধ্ববাহু নৃত্যরত চৈতন্যের যে বিগ্রহ পরের পাঁচশো বছরে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, তার প্রথম দর্শন মিলেছিল এই শহরেই অদ্বৈতাচার্যের বাড়িতে।

শান্তিপুর কিন্তু শুধু চৈতন্যতীর্থই নয়। ইংরেজ আমল পর্যন্ত শহরটির রীতিমতো গুরুত্ব ছিল। এখনও সুরধনী গঙ্গার পাশে ভগ্নস্তূপটির দেওয়াল জুড়ে গোবরের ঘুঁটে দেখা যায়, তা আসলে রেশম কুঠির হাতিশালা। এক সময় শান্তিপুরে প্রচুর নীল ও রেশম চাষ হত। এই রেশম কুঠি সেই ইতিহাসের সাক্ষী। কিন্তু অবহেলা আর অনাদরে আজ তার পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। শুধু এই হাতিশালাটাই কোনও মতে টিকে আছে। বাঙালির ইতিহাসে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ের নিদর্শন চোখের সামনে হারিয়ে গেল। শহরের এক প্রবীণ নাগরিকের কথায়, “অথচ আমরা কেউই কিছু করলাম না। যাঁদের করার কথা ছিল, তাঁরা ফিরেও তাকালেন না।”

শুধু নীলকুঠি কিংবা রেশমকুঠিই নয়। শান্তিপুরের সর্বত্র এ ভাবেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অজস্র স্থাপত্য আর ইতিহাসের নানা উপকরণ। সেই তালিকায় যেমন রয়েছে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের নামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা তোপখানার মসজিদ, ইটের তৈরি আটচালার শ্যামচাঁদ মন্দির, ঔরঙ্গজেবের সেনাপ্রধান গাজী ইয়ার মহম্মদের তৈরি তোপখানা মসজিদ, ১৭৯৬ সালে তৈরি দানবীর মরহুম শরিবত সাহেবের তৈরি সুদৃশ্য মসজিদ, ওস্তাগর পাড়ার মসজিদ-সহ প্রায় ২৬টি মসজিদ, সম্প্রীতির মেলবন্ধন শৈশব তলা, সৈয়দ সাহেবের মাজার, ব্রাহ্মসমাজের বাড়ি। এ ছাড়াও রয়েছে শান্তিপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় গোস্বামী বাড়ি-সহ ২৪টি বিগ্রহবাড়ি। তার মধ্যে ৯টি গোস্বামীবাড়ি বলেই পরিচিত। শান্তিপুর শহরের একেবারে লাগোয়া এলাকায় রয়েছে অদ্বৈতাচার্যের সাধনক্ষেত্র অদ্বৈতপীঠ। সেই সঙ্গে আছে একাধিক শিব ও কালী মন্দির। যেমন আগমেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, গোকুলচাঁদ মন্দির, বংশীধারী শিবমন্দির, সূত্রাগড়ে গণেশ মন্দির, জলেশ্বরের শিবমন্দির, শ্যামচাঁদ মন্দির। এই সব মন্দির ও বিগ্রহবাড়ির সঙ্গে শুধু যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে তাই নয়, এই সব মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির কাজ বাংলার অন্যতম দর্শনীয় বিষয়। আবার কারও কারও দাবি, এই শহরে ছিল বৌদ্ধস্তূপও। কিন্তু কালের নিয়মে তাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

প্রাচীন কাল থেকে শান্তিপুর শহরে নানা সময়ে নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করছেন। রেখে গিয়েছেন তাঁদের ধর্মচর্চার নিদর্শন। মন্দির, মসজিদ কিংবা ব্রাহ্মসমাজের এ ভাবে ‘গলা জড়াজড়ি’ করে থাকাটাকেই শান্তিপুর শহরকে অন্যদের তুলনায় আলাদা করেছে বলেই দাবি করেন শান্তিপুরের মানুষ। কিন্তু সেই সঙ্গে এই শহরের মানুষের প্রশ্ন-- এত যার বৈচিত্র্য, এত যার বৈভব সেই শান্তিপুর কেন আজও বাংলার পর্যটন মানচিত্রে সে ভাবে জায়গা করে নিতে পারল না? কেনই বা এই শহর তার এত সমৃদ্ধ ইতিহাস আর স্থাপত্য শিল্পকে বুকে নিয়েও নিঃসঙ্গ পড়ে থাকবে? কেন শুধু অনাদরে নষ্ট হয়ে যাবে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে সুদৃশ্য টেরাকোটার কাজ? কেন নীরবে হারিয়ে যাবে নীলচাষের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন?

অথচ এই শহরেই এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য। এই শহরেই বাস করতেন চৈতন্যের শিক্ষক অদ্বৈতাচার্য। এই শহর বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর জন্মভূমি। বড় গোস্বামীবাড়ির বংশধর তথা সাহিত্যিক সত্যনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “অদ্বৈতাচার্যের বংশের ৯টি শাখার যে বিগ্রহবাড়ি আছে সেগুলি শুধু বৈষ্ণব ভক্তদের কাছেই নয়, সমস্ত বাঙালির কাছে আকর্ষণীয় বিষয়। এই শহর বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র। অথচ ভাবতে খারাপ লাগে, অদ্বৈতচার্যের এই সাধনতীর্থের অপর দিয়ে পর্যটকরা চলে যান মায়াপুরে। মুসলিম সমাজেরও নানা ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থান আছে এই শহরে। কিন্তু সে সব মানুষের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে।” তাঁর কথায়, “এত কিছু উপাদান থাকা সত্ত্বেও শান্তিপুর কেন যে পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠল না, তা আমরাও বুঝতে পারি না। আসলে শান্তিপুরকে সে ভাবে তুলে ধরার ব্যাপারেও তেমন কোনও পরিকল্পনা কেউ করেননি।”

অথচ শুধুমাত্র স্থাপত্য বা ঐতিহাসিক কারণেই নয়, ভৌগলিক অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেও পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠার সব সুবিধাই রয়েছে শান্তিপুরের। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভাগীরথী। শহরের বুক চিরে চলে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। শান্তিপুর-শিয়ালদহ শাখার রেল চলাচল এই শহরকে কলকাতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করেছে। কিন্তু এত কিছু উপকরণ থাকা সত্ত্বেও শান্তিপুর যেন থেকে গিয়েছে দুয়োরানি হয়েই। আর সেই কারণেই শহরে থাকা ও খাওয়ার মতো ভাল হোটেল আজও গড়ে ওঠেনি। পুরসভার নিজস্ব দুটি লজ আছে। সবেধন নীলমণি বলতে ওইটুকুই। স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কথায়, “এই শহরে পর্যটক কোথায় যে, মানুষ পয়সা খরচ করে হোটেল তৈরি করবে।”


তোপখানা মসজিদ।

শুধু যে স্থাপত্য বা ইতিহাসের সাক্ষী হতেই এই শহরে মানুষ আসবেন তাই নয়। এই শহর তাঁতের কাপড়ের জন্য বিখ্যাত। পর্যটকরা এলে তাঁতের কাপড়ের ব্যবসাও আরও চাঙ্গা হবে বলে মনে করেন শহরের তাঁত শিল্পীরা। এই শহরের অভিযোগ, এই শহর যে আজও পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি পেল না, তার দায় সকলেরই। এখনও পর্যন্ত পুরসভা দর্শনীয় স্থানগুলিকে চিহ্নিত করে একটা মানচিত্র তৈরি করে উঠতে পারেনি। সংরক্ষণের অভাবে ভগ্নপ্রায় সাহিত্য পরিষদ ও পুরাণ পরিষদে নষ্ট হতে বসেছে বহু মূল্যবান পুঁথি। একই ভাবে এই শহরের অন্যতম কৃতী সন্তান, সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়, কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, বীর আশানন্দ, নাট্যকার অহীন্দ্র চৌধুরী, যোগাচার্য শ্যামসুন্দর গোস্বামী আর কাছেই হরিপুরে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের বাড়ি সংস্কারের অভাবে আজ জীর্ণ। শান্তিপুর শহরে ঢোকার আগে ফুলিয়ায় বাঙালির আর এক কৃতী সন্তান কৃত্তিবাসের জন্মভিটে।

সব মিলিয়ে যে শান্তিপুর বাংলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারত সেই শান্তিপুর কেন আজও উপেক্ষিত তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে এই শহরের মানুষের মনে। সম্প্রতি এই শহরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্য শিল্পের উপরে স্থিরচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন শান্তিপুরেরই বাসিন্দা অমিতাভ মিত্র। অমিতাভবাবু বলেন, “দীর্ঘ দিন ধরে এই শহরকে নিয়ে কাজ করতে দিয়ে দেখেছি, কীভাবে চোখের সামনে মূল্যবান সব শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের সব উপাদান। অথচ শহরের এই সব সম্পদকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোনও দিনই কারও উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ল না। সেই কারণে মাঝে মধ্যে খুব হতাশ লাগে।” একই কথা বলছেন শান্তিপুর পুরসভার বিরোধী দলনেতা সিপিএমের সোমেন মাহাতো। তিনি বলেন, “এত সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু উদ্যোগের অভাবে শান্তিপুর পর্যটন মানচিত্রে সে ভাবে জায়গা করে নিতে পারল না। সেটা হলে শান্তিপুরের অর্থনীতিতেও একটা বিরাট পরিবর্তন আসত।”

যদিও এমন অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূলের পুরপ্রধান অজয় দে। তাঁর দাবি, “আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই নানা ভাবে শান্তিপুরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমাদের উদ্যোগেই বিভিন্ন পর্যটন স্থানগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।” অজয়বাবু জানান, পুরসভার উদ্যোগেই বছর কয়েক আগে হেরিটেজ কমিশন প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে তোপখানা মসজিদ, গোকুলচাঁদ বাড়ি মন্দির ও ব্রাহ্মসমাজের বাড়ির সংস্কার করেছে। এ ছাড়াও জলপথে কলকাতার সঙ্গে নবদ্বীপ, কালনা ও ফরাক্কার পাশাপাশি শান্তিপুরেও বড় লঞ্চ বা ক্রুজের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। ইতিমধ্যে শান্তিপুরের বড়বাজার ঘাট ও গুপ্তিপাড়ার ঘাটকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। শ্যামচাঁদ মন্দির পুরাতত্ত্ব দফতর অধিগ্রহণ করেছে।

অজয়বাবু বলেন, “পরবর্তী বাজেটে সার্কিট টুরিজম প্রকল্পের মাধ্যমে শান্তিপুরকে ঢেলে সাজার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেই কাজের প্রথম পর্যায়ে প্রায় দু’কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সেই টাকায় ভাগীরথীর চরে একটি ইকোটুরিজম, বাবলার অদ্বৈতপাঠে একটি ধর্মশালা, একটি সংগ্রহশালা ও দু’টি তোরণও তৈরি হবে। এই পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হলেই শান্তিপুর প্রকৃত অর্থেই একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসবে।”

কিন্তু এতদিন হল না কেন?

অজয়বাবু বলছেন, “সেটা করতে হলে যে বিরাট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা ব্যয় করার ক্ষমতা পুরসভার নেই। তাই বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে শান্তিপুরকে সাজানোর চেষ্টা করছি।” (চলবে)

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE