বিড়ি কারখানায় চলছে শ্রমিকদের কাজ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
বিড়ি শিল্পাঞ্চল হিসেবে অরঙ্গাবাদের নাম সুবিদিত। এলাকার সিংহ ভাগ মানুষের আয়ের প্রধান উত্স বলতে বিড়ি বাঁধাই। তাই ছেলেমেয়ে মানুষ করা থেকে মেয়ের বিয়ে দেওয়া সবেরই জন্য নিভর্র করতে হয় বিড়ির উপর। তাই কেউ কেউ আবার অরঙ্গাবাদকে বিড়ির শহর নামেই চেনেন। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে তামাক বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে। ভারতও সেই আন্দোলনের শরিক। সাম্প্রতিক কালে তামাকের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে ভারত সরকার কিছু পদক্ষেপ করেছে যা বিড়িশিল্পে সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত বলেও ভাবছেন কেউ কেউ। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন শিল্পে যদি সত্যই মন্দা দেখা যায় তাহলে কী করে খাাবেন তাঁরা।
অরঙ্গাবাদে শহরে রয়েছে প্রায় ২০টি মতো বিড়ির বড় কারখানা। ছোট কারখানা রয়েছে অন্তত গোটা দশেক। দৈনিক অন্তত চল্লিশ কোটি বিড়ি তৈরি হয় অরঙ্গাবাদে। কোনও কোনও পরিবার রয়েছে যাদের আয়ের একমাত্র উত্স বলতে বিড়ি বাধাঁই। আবার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ ছাড়তে পারেননি কেউ কেউ। বরজপাড়ার আব্দুর রাকিব ও স্ত্রীর দু’জনের বিড়ি বাঁধাই করে কলকাতায় দুই ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর খরচ জুগিয়েছেন। বড় ছেলে এখন একটি বড় কোম্পানিতে কর্মরত। মেয়ে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তবুও বিড়ি বাঁধাইয়ের কাজ ছাড়তে পারেননি। শুধুমাত্র অরঙ্গাবাদ কলেজপাড়াতেই অন্তত ২৫ জন এমএ পাশ যুবকের দেখা মিলবে যাঁদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উত্স বলতে বিড়ি বাঁধাই। কিন্তু সারা বিশ্ব জুড়ে যে তামাক বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ব্যাপারটা কী রকম?
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) টোবাকো নিয়ে বিধি নিষেধ কার্যকরী করার চুক্তিতে সই করে ভারত-সহ ১৫০টি দেশ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এক বছরে ভারতে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় শুধুমাত্র ধূমপানের কারণে। যার অর্ধেকই মারা যান ক্যানসারে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় শুধুমাত্র তামাকজনিত রোগের পিছনে। যা তামাকজাত উত্পাদন থেকে আদায়ীকৃত রাজস্বের অন্তত চার গুণ বেশি। যেহেতু যাঁরা বিড়ি পান করেন তাঁদের অধিকাংশই মানুষ লেখাপড়া জানেন না তাই ২০০৬ সালের ৫ জুলাই প্রতিটি বিড়ির প্যাকেটে ক্যানসার আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির ছবি ছাপিয়ে সতর্কীকরণ সংক্রান্ত প্রচার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ জারি করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। পরে অন্তত ১০ বার নানা মহলের চাপে ওই নির্দেশ কার্যকরী করার কাজ স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আর তা স্থগিত রাখতে চাইছে না। বিড়ি মালিকদের ক্ষোভ, এত দিন বিড়ির প্যাকেটের গায়ে ৪০ শতাংশ জায়গা জুড়ে ওই ছবি ছাপা হত। বর্তমান সরকারের নির্দেশ, প্যাকেটের ৮৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে ছাপতে হবে সেই ছবি। এই বীভত্স ছবি প্যাকেট জুড়ে ছাপালে বিড়ি বিক্রি কমবে বলে আশঙ্কা তাঁদের। ফলে বিড়ি শিল্প সঙ্কটে পড়বে। শ্রমিকরা কাজ হারাবে বলে জানান তাঁরা।
অরঙ্গাবাদ কলেজের অধ্যাপক সাধন দাস জানান, “অরঙ্গাবাদের মূল অর্থনীতিটাই দাঁড়িয়ে আছে বিড়ি শিল্পের উপর। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিনিষেধ মেনে ‘তামাক আইন ২০০৩’ কার্যকরী হলে অরঙ্গাবাদের বিড়ি শিল্পের উপর তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। আশঙ্কার জায়গা সেটাই।” এলাকার বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে একাধিকবার। সরকারি ভাবে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু’ও। সেখানে দেখা গিয়েছে, খোদ অরঙ্গাবাদেই ১০ বছরের কম বয়সী বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ২০ শতাংশ। যাদের অধিকাংশই স্কুল পড়ুয়া।
সবারই আশঙ্কা যদি বিড়ি শিল্পে মন্দা দেখা যায় তাহলে স্থানীয় বাসিন্দাদের রুজি রোজগারের কী হবে তা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে সব মহলেই। বিকল্প পথের কথা অবশ্য ভাবছেন কেউ কেউ। রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে পাট উত্পাদিত হয় মুর্শিদাবাদে। সে ক্ষেত্রে পাটকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প রুজির পথ খোলা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী মলয় গুপ্ত মনে করেন, “সারা বিশ্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। বহু দেশে ইতিমধ্যেই তা নিষিদ্ধ। ফলে পাটজাত সামগ্রীর গুরুত্ব বাড়ছে।” কিন্তু এ পর্যন্ত অরঙ্গাবাদ-সহ এ জেলার কোথাও সেভাবে পাটজাত শিল্পই গড়ে তোলার চেষ্টা হয়নি আজও।
বিড়ি মালিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার জৈন বলেন, “বিড়ি মালিকেরা সরকারি নিষেধাজ্ঞা মানতে বাধ্য। কিন্তু আইন কার্যকরী করার আগে বিকল্পটা অবশ্যই ভাবতে হবে। তা না হলে মালিকদের থেকে বেশি সঙ্কটে পড়বেন শ্রমিকেরাই। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সে কথা জানিয়েছি।” সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য অমল চৌধুরীর মতে, “এমনিতেই প্রযুক্তির জন্য শিল্প ক্ষেত্রে কর্ম সংস্থানের পথ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিড়ি শিল্পে সঙ্কট অরঙ্গাবাদকে কার্যত পথে বসিয়ে দেবে।”
কংগ্রেসের বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক বাদশার আলির মতে, “২০০৩ সাল থেকে তামাকজাত নিষেধাজ্ঞা বিধি চালুর কথা চলছে। অথচ কেন্দ্রীয় বা রাজ্য কোনও সরকারের তরফেই বাজেটে কোনও আর্থিক বরাদ্দ জোটেনি। অরঙ্গাবাদের শ্রমিকদের জন্য বিকল্প রুজির ভাবনা চিন্তাও করা হয়নি।”
সুতির তৃণমুল বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস অবশ্য রাতারাতি বিড়ি শিল্প এভাবে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে নন। তিনি বলেন, “অরঙ্গাবাদে বিড়ি শ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা। বিড়ি শিল্প পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে কোথায় যাবেন তারা?” তাঁর দাবি, “বর্তমানে বিড়ির মজুরি বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে অরঙ্গাবাদে। রাজ্যের বর্তমান সরকার চান শ্রমিকদের ১৭৩ টাকা করে ন্যূনতম সরকারি মজুরি চালু হোক বিড়ি শিল্পেও।” তাঁর কথায়, “জোর করে কোনও শিল্পকে বন্ধ করা কোনও কাজের কথা নয়। এলাকায় শিক্ষার প্রসার ঘটলে সচেতনতা বাড়বে। তখন বিড়িতে বিপদ বুঝে ধীরে ধীরে শ্রমিকেরাই খুঁজে নেবে বিকল্প রুজির পথ।”
কউ বলেন অরঙ্গাবাদ, কেউ ডাকেন অরঙ্গাবাদ বিড়ি শিল্প শহরের নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানাবিধ জনশ্রুতি স্থানীয় বিএড কলেজের ইতিহাস শিক্ষক মহম্মদ সামসুদ্দিনের কথায়। ‘মোগল রাজ পরিবারে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত যখন চরমে তখন সুতি এলাকায় শিবির স্থাপন করেছিলেন ঔরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী। চাঁদমারি নামক স্থানে দাদা সুজার সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি মীরজুমলার যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে মীরজুমলা যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসেবে ঔরঙ্গজেবের নামানুসারে ঔরঙ্গাবাদ গ্রামের প্রতিষ্ঠা করেন।”
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy