তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইল। পুজোর মুখে ব্যস্ত শিল্পীরা। ফুলিয়ায় ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।
সুতো আর রং দুইয়ে মিলে শাড়ি।
আর তার সঙ্গে শরতের রোদ খানিক মিশিয়ে দিলে যা হয়, তাকেই বঙ্গনারী বলেন ‘শারদোৎসব’। বলেন সুতোকে কথা বলানো তাঁতিরাও।
ফলের রাজা যদি আম হয় আর বনের রাজা বাঘ, শাড়ির রানি তবে কিনি? রাজারাজড়ার চোখের জরিপ বলবে, মসলিন। কিন্তু আংটির ভিতর দিয়ে গলে যাওয়া মসলিনের দাম চোকাতে যে রাজকোষ লাগে! তা আছে ক’জনের?
কিছুটা কমতি করে এ বার পুজোয় বাজারে আসছে নতুন এক মসলিন। যা না কি ভাঁজ করে টিফিন কৌটোয় ভরে ফেলা যায়! সাত ইঞ্চি বাই সাত ইঞ্চির ভাঁজে নিপাট পালকের মতো হাল্কা শাড়ি। ওজন মেরেকেটে ৩৫০-৩৭৫ গ্রাম। সিল্কের সুতোয় বোনা জমিতে সুতো দিয়ে হাতে গড়া কল্কা। জড়ি-চুমকির লেশমাত্র নেই। পাড়ের বাঁধাইয়েও মোটা সুতির বুনুনি।
শুধু কি মসলিন?
নদিয়ার শান্তিপুর, ফুলিয়া, সমুদ্রগড়, নবদ্বীপ কারিগরেরা এখন তুমুল ব্যস্ত। চিরন্তনী তাঁতকে নতুন ছাঁচে ঢেলে সাজাতে চাইছেন তাঁরা। শান্তিপুরের নামী কারবারি অসিতকুমার বিশ্বাসের ঘরে বোনা হচ্ছে নতুন মসলিন। জামদানিও পাচ্ছে নতুন চেহারা। সাবেক জামদানি একরঙা। এ বার বারো হাত শাড়িকে ছয় হাত করে ভাঙছেন শিল্পীরা। দুই অংশে ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন দু’টি রঙ। দেখতে অনেকটা মেখলার মতো। অসিতবাবুর ছেলে দীপাঞ্জনের কথায়, “এখন তো ভাইব্র্যান্ট রঙের বাজার। তাই লাল-কালো, হলুদ-ম্যাজেন্টা, লাল-সাদা বা তুঁতে-সাদা রঙ দিয়ে করছি এই হাফ-হাফ শাড়ি। কিছু জামদানি পাটলিপাল্লুর ঢঙেও পাওয়া যাবে। তারও কুচি আর আঁচলে উজ্জ্বল রঙ। বাকিটা হয়ত সম্পূর্ণ কনট্রাস্ট।”
ফুলিয়ার নামী শাড়ি উৎপাদক বীরেন বসাক আবার জামদানি বুনছেন বিশেষ ‘সফ্ট কটন’ সুতোয়। ঘন জমির উপরে হাল্কা কাজ অথবা হাল্কা জমির উপরে গাঢ় কল্কাদার কাজ খাদির সুতোয় বোনা। দাম দেড় থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে। সমুদ্রগড় আবার মেতেছে রঙের খেলায়। এ বার তাদের বাজি তিনরঙা ‘থ্রি ডি শাড়ি’। দু’দিকের পাড়ে দু’টি রঙ, মাঝ বরাবর অন্য একটি রঙের ব্যবহারে বাড়তি মাত্রা। ‘মার্সেলাইজড কটন’ সুতোয় বোনা, আঁচলে জরির কাজ। এই শাড়ি যাঁরা করছেন তাঁদের অন্যতম চিন্ময় কুণ্ডুর মতে, “এ হল বালুচরির প্রচলিত ঘরানার সঙ্গে পাটলিপাল্লুর ফিউশন।” দাম দুই থেকে আড়াই হাজারের মধ্যে।
নদিয়ার তাঁতের আঁতুড়ে রয়েছে আরও কিছু চমক। যেমন সিন্থেটিক সুতো এবং মার্সেলাইজড কটনে বোনা মাল্টিকালারড ঢাকাই, ঢাকাইয়েরই ধরনে একরঙা বাহা শাড়ি, নেটের ব্যবহারে শীতলপাটি কিম্বা ঢাকাই রঙ্গবতী এ বারের বড় হাতছানি। জামদানি, বালুচরি, ঢাকাই, পাটলিপাল্লুর চেনা ঘরানা ভেঙেচুরে নানা রকম সুতো শাড়ির মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। চিন্ময়বাবু জানান, রঙ্গবতী শাড়িতে সিন্থেটিক সুতো এবং মার্সেলাইজড কটনের মিশ্র ব্যবহার রয়েছে। ফলে, শাড়িতে এক সঙ্গে তিন-চারটে রঙের শেড পর্যন্ত থাকছে। এত দিন যে ঢাকাই সাধারণত একরঙা হত, তাতেও এই প্রথম তিন-চার রঙ আনা হচ্ছে। ২৭০০ থেকে ৩২০০ টাকা দামের এই শাড়ির জন্য চেন্নাই থেকে এসেছে বিশেষ সুতো।
গত বারের হিট বাহা শাড়ির ডিজাইনেও ব্যাপক রদবদল ঘটছে। কুচির কাছে লম্বা স্ট্রাইপের চেনা বাহা-র এ বার নয়া বাহার। তাঁতিরা বলছেন ‘বাহা রিমেক’। ঢাকাইয়ের ধরনে ‘প্লেন বডি’ আর জমকালো কল্কাদার পাড়। আঁচলে জমাট ভারী নকশা, কিন্তু গোটা শাড়ি হাল্কা। মাড়ের কড়কড়ে ভাবটাও থাকবে না। নবদ্বীপের অন্যতম শাড়ি ব্যবসায়ী রাজেশ অগ্রবাল বলেন, “বাহা শাড়ির পুরো কনসেপ্টটাই বদলে গেছে। আটশো থেকে বারোশো টাকার মধ্যে এই শাড়ি এ বার খুব চলছে।” সিরিয়ালের বাহাকে আবার তাড়া করছে ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’। পিওর সিল্কের উপরে পাড়, আঁচলে চেক। গোটা শাড়ি প্লেন। দাম চার থেকে ছয় হাজার টাকা। বাজার ভাল তসরের উপরে এমব্রয়ডারি করা শাড়ি এবং পৈথানি, পাটোলা, কেরালা কটন কিংবা কেরালা সিল্কেরও। রাজেশবাবু জানান, হাতে বোনা তাঁতে সুতি আর সিল্কের মিশ্র মাধ্যমের শাড়ি ‘হ্যান্ডলুম কটন’ও লোকের মনে ধরেছে। দাম দেড় থেকে আড়াই হাজারের মধ্যে। নানা ধরনের সিল্কের টুকরো জুড়ে ‘কাট পিট’ নামে নতুন ডিজাইনের শাড়িরও চাহিদা ভাল।
বাহারের সঙ্গে অবশ্য দক্ষিণাও বাড়ছে। একে তো রঙ আর সুতোর দাম লাফিয়ে বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শিল্পীদের মজুরিও। ফলে একটু অন্য রকম শাড়ি মানেই দাম হাজার ছাড়াচ্ছে। তার তুলনায় পাওয়ার লুমে বোনা কাপড়ের দাম বেশ কম। সমুদ্রগড়ের ধাত্রীগ্রামের টাঙ্গাইল তাঁতবস্ত্র সমিতির প্রাক্তন সম্পাদক তথা প্রবীণ ব্যবসায়ী কার্তিক ঘোষ বলেন, “যা আমাদের নিজস্বতা, সেই ধরনের শাড়ির চাহিদায় এখন একটু ভাঁটার টান। গুজরাত বা বেনারস থেকে পাওয়ার লুমে বোনা যে কাপড় আসছে, তার সঙ্গে দামে সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল হচ্ছে।” আবার ফুলিয়ার বীরেন বসাকের ভয় আবার অন্য জায়গায়। তাঁর মতে, “সবচেয়ে বিপদের কথা পলিয়েস্টারে তৈরি শাড়ি তাঁতের বলে দেদার বিক্রি হচ্ছে। লোকে না বুঝে কিনছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এর জন্য দায়ী। এ জিনিস চলতে থাকলে সাবেক তাঁতের ধ্বংস অনিবার্য।”
চকচক করলেই যে সোনা হয় না, তা বাঙালি প্রায়ই ঠেকে শেখে। তাঁত বলে চালিয়ে দিলেই যে ধোঁকা খেতে নেই, তা-ও বুঝি শেখার সময় হল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy