ধান ঝাড়াইয়ের কাজ চলছে বাগ পরিবারে। —নিজস্ব চিত্র।
প্রতি বছর এই ভাবেই উঠোনে ধান নামত। ঝাড়াই-বাছাইয়ের পালা শেষ হলে উনুনটা গোবরে নিকিয়ে শুরু হয়ে যেত ঘুঘুড়াগাছির বাগ পরিবারের পিঠে-পুলির প্রস্তুতি। এবারও অন্যের জমিতে ভাগ চাষ করে ধান ফলিয়েছেন দেবানন্দ বাগ। সোনার ধান অন্য বারের মতো এবারও গোরুর গাড়ি বোঝাই করে এসেছে। চলছে ঝাড়াই-বাছাই। কিন্তু কারও মনে আনন্দের রেশটুকু নেই। আলপনা দিয়ে পিঠে-পুলি বানানোর মানুষটিই যে নেই আর। জমি বাঁচাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়েছেন এই বাড়িরই কর্ত্রী অপর্ণা বাগ। গত ২৩ নভেম্বরের সেই দিনটির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না কৃষ্ণগঞ্জের সীমান্ত ঘেষা গ্রাম ঘুঘড়াগাছি।
২২ বিঘা জমির দখল নিতে সেই সকালে ট্রাক্টর নিয়ে হানা চালিয়েছিল স্থানীয় একদল দুষ্কৃতী। ট্রাক্টরের চাকায় জমি তছনছ হতে দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি অপর্ণাদেবী। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন সাহস করে। দুষ্কৃতীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে বিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। দুই মহিলা ও এক কিশোরও জখম হয়েছিলেন গুলিতে। পরে ওই ঘটনায় লঙ্কেশ্বর ঘোষ নামে স্থানীয় এক জমির কারবারি-সহ বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। এর মধ্যে লঙ্কেশ্বর ওরফে লঙ্কাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু বাকিরা অধরাই। তার চেয়েও বড় কথা হল দোষীরা শাস্তি পাক বা না পাক, মৃতের অভাব পূরণ হওয়ার নয় কোনও দিন।
শীতের সকালে উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নতুন ধানের বোঝার দিকে তাকিয়ে দেবানন্দবাবু বলেন, ‘‘নতুন ধান উঠলে বাড়িতে উত্সবের মেজাজ শুরু হয়ে যেত। অপর্ণা সব কিছু একা হাতে করে আমাদের খাওয়াতো। পড়শিদেরও দিত। সমাজবিরোধীদের গুলি শুধু ওর প্রাণটাই নেয়নি। আমাদের পরিবারটাকেও ছারখার করে দিয়েছে। খেজুর গাছের নলেন গুড়, নতুন ধানের গন্ধ সবই আছে আগের মতো। সেগুলো নিয়ে যে আনন্দ করত, সে আজ চলে গিয়েছে অনেক দূরে। সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এবারও গ্রামেরই মন্টু বাগের ১৬ কাঠা জমিতে ধান ফলিয়েছেন দেবানন্দবাবু। সেই ধান মাঠ থেকে কেটে নিয়ে আসা হয়েছে বাড়িতে। সকাল থেকে ধান ঝাড়া মেশিনে সেই ধান ঝাড়ছেন মন্টু বাগের ছেলে-বউমা। তাঁদের বাড়িতে জায়গা নেই বলে বাগেদের বাড়িতে ধান ঝাড়ার ব্যবস্থা। উঠোনে সেই কর্মকাণ্ডের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অপর্ণাদেবীর বড় মেয়ে নীলিমা। তাঁর কথায়, ‘‘আজ মা থাকলে কত আনন্দ করত। কবে কী পিঠে বানাবে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে যেত এতক্ষণে। যত এ সব দেখছি, মায়ের জন্য ততই মন খারাপ করছে। মাকে যারা মারল, তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই।’’
দু’দিন আগে এই নীলিমাই শাসকদলের সভায় যাবেন না বলে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছিলেন। আর শাসকদলের সভায় যাওয়ার ভয়ে দুপুরেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দেবানন্দবাবু ও তাঁর ছেলে দীপঙ্কর। এদিন সাদা কাপড়ের কাছা পড়া কিশোর দীপঙ্কর উদাস চোখে নতুন ধানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘‘মা নেই। তাই আমাদের আর কিছুই নেই। আমাদের একমাত্র সম্বল ওই সাত কাঠা জমি যাতে দখল হয়ে না যায় তার জন্য মা সেদিন মাঠে ছুটে গিয়েছিল। যে সংসার বাঁচাবে বলে মায়ের এই আত্মত্যাগ, সেই সংসারে সুখ বিদায় নিয়েছে চিরতরে।”
শীত পড়েছে। নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে গ্রামে-গ্রামে। দুয়ারে নবান্ন। শোকস্তব্ধ গ্রামে সে দিকে যেন কারও খেয়াল নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy