শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ সেই ছাত্র। ফাইল চিত্র
রাতের ট্রেনে কৃষ্ণনগরে নেমে মোটরবাইকে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন প্রাথমিক স্কুলের এক শিক্ষক। ফাঁকা সুনসান রাস্তায় ক্ষৌণীশ পার্কের কাছে আচমকা টলতে টলতে রাস্তা পার হয়ে গেল এক মদ্যপ যুবক। কোনও রকমে দুর্ঘটনা এড়ানো গেলেও রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে উড়ে এল অশ্রাব্য গালিগালাজ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বাইকের গতি বাড়িয়ে তড়িঘড়ি বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন ওই স্কুল শিক্ষক। ক্ষৌণীশ পার্কের ওই এলাকার ততক্ষণে দখল নিতে শুরু করেছে সমাজবিরোধীরা।
মাস তিনেক আগে ওই এলাকাতেই ভরসন্ধ্যায় দুষ্কৃতীদের গুলির লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্রকে। সেই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন সমাজবিরোধীকেও। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। ওই স্কুলশিক্ষক একা নন, সন্ধ্যার পরেই কৃষ্ণনগরের রাতের রাস্তায় এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃষ্ণনগরের মোংলাপাড়া ও সংলগ্ন এলাকায় বাইরের সমাজবিরোধীদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। ওই এলাকার বেশ কিছু পরিচিত সমাজবিরোধী এখন জেলে বা এলাকার বাইরে চলে যাওয়ায় তাদের জায়গা দখল করছে সমাজবিরোধীদের অন্য গোষ্ঠী। বিশেষ করে ঘোড়াপোট্টি, মোংলাপাড়া এলাকায় আবার নতুন করে সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। মোংলাপুকুর মাঠের পাশে একটি চায়ের দোকানে সন্ধ্যের পরে গাঁজার ঠেক বসতে শুরু করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই ঠেকে বহিরাগত মুখের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। এ ছাড়া কিছুদিন আগেও পুলিশের ভয়ে যারা এলাকা ছাড়া হয়ে গিয়েছেল তারাও কিন্তু মোটরবাইকে এসে এলায়ায় ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। আসলে তারা সকলেই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইছে, বলছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অথচ এই সব এলাকা যে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে এমনটাও জোর দিয়ে বলা যায় না।
কৃষ্ণনগরের এক বাসিন্দার কথায়, “বেলেডাঙায় ওই ছাত্র খুনের ঘটনার পরে পুলিশের তাড়া খেয়ে সমাজবিরোধীরা শীত ঘুমে চলে গিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। জেল থেকে ফিরে কিংবা বিরোধী গোষ্ঠীর দুষ্কৃতীরা ফের জেগে উঠলেই বোঝা যাবে কৃষ্ণনগর আছে কৃষ্ণনগরেই।”
প্রায় একই কথা বলছেন জেলা পুলিশের এক কর্তাও। তাঁর কথায়, “এখন শহরে তেমন অপরাধ হচ্ছে না বলে আনন্দিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ দুষ্কৃতীরা বেশি দিন নিজের এলাকা ছেড়ে বাইরে থাকে না। এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয় সবসময় কাজ করে। তারা যে কোনও সময় ফিরে আসতে পারে।” তিনি জানান, পুলিশ ধারাবাহিক ভাবে দুষ্কৃতীদের চাপে না রাখলে বা নিয়মিত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শহরের পরিবেশ ফের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
কৃষ্ণনগরের পুরপিতা তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময় শহরে অপরাধমূলক কাজ ঘটে চলেছে। আমরা প্রশাসনকে বারবার সতর্কও করেছি। কিন্তু তেমন বিরাট কোনও পরিবর্তন দেখছি না। প্রশাসনের পর্যাপ্ত নজদারির অভাবেই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। যেমন ক্ষৌণীশ পার্ক থেকে চার গেটের রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।” তিনি জানান, শহরের বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পুলিশের টহলদারি বাড়ানো উচিত।
যা শুনে জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, “পুরপ্রধান ঠিকই বলছেন। কিন্তু তাঁরও তো কিছু দায় থেকে যায়। যে সব এলাকায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য রয়েছে, খেয়াল করে দেখুন, সেই সব এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর অভাব আছে। এই কাজগুলো তো আর পুলিশ করবে না!” অসীমবাবু বলেন, “শহরের সর্বত্রই আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। কিছু জায়গায় সমাজবিরোধীরা নিজেদের কাজকর্মের সুবিধার জন্য আলো নষ্ট করে দেয়।”
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কৃষ্ণনগরের মতো শহরের রাতের রাস্তাগুলি নিরাপদ নয় কেন? সেটা কি শুধু পুলিশ-প্রশাসন আর পুরসভার দায়? নাকি এর পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনও গভীর অসুখ?
জেলা পুলিশের একাংশের দাবি, পুলিশ চাইলে করলে অনেক কিছুই করতে পারে। বেলেডাঙায় ছাত্র খুনের পরে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করে পুলিশ সেটা করেও দেখিয়েছে। কিন্তু পুলিশকিছু করছে না কেন? ওই পুলিশ কর্তা বলছেন, “আসলে এই দুষ্কৃতীরা সব সময় ক্ষমতাসীন দলের কোনও না কোনও নেতার ছত্রছায়ায় থাকে। সেই নেতারা নিজেদের স্বার্থে এদের ‘শেল্টার’ দেন। সেই কারণে খুব বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে সব জেনেও আমরা এদের ছুঁতে পারি না। এটাই বাস্তব।”
জেলা বিজেপির মুখপাত্র সৈকত সরকার বলেন, ‘‘জনপ্রতিনিধিরা সকলেই জানেন তাঁদের এলাকায় কোন কোন সমাজবিরোধীর উত্থান হচ্ছে আর কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কোনও ব্যবস্থা নেয় না। ব্যবস্থা নিলে ভোটের সময় কী হবে? তাই পুলিশ চাইলেও কিছু করার থাকে না। ফলে রাতের রাস্তাও আর নিরাপদ থাকে না।”
জেলা তৃণমূলের সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত বলেন, “গোপাল ভাঁড় বেঁচে থাকলে এ সব শুনে হাসতেন। এই ধরনের কোনও কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।”
সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম সাদি বলেন, ‘‘সত্তর সাল থেকে এই শহরের দুষ্কৃতীদের নিয়ন্ত্রণ করে আসছে ডানপন্থী দলগুলি। কংগ্রেসের পরে এখন সে সব সামলাচ্ছে তৃণমূল। ফলে রাতের রাস্তা নিরাপদ নয়ই, দিনের রাস্তাও যে কতটা নিরাপদ তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।”
পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময় নানা ঘটনায় আমরা শহরের বেশ কিছু দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছি। তারা এখন জেলে। এই শহর এখন পুরোপরি নিরাপদ। এই শহরকে নিরাপদে রাখার জন্য সব জায়গাতেই পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে।”
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy