দু’কিলোমিটার হেঁটে ধান খেতের শ্যালোর জলে স্নান করতে যাচ্ছেন মেদিনীপুর সদর ব্লকের দহ গ্রামের বাসিন্দারা। সজল ধারা প্রকল্পে বসানো পাম্পে জল ওঠে না। পানীয় জলের জন্য হাতে গোনা কয়েকটি টিউবওয়েলের ওপরে ভরসা প্রায় দেড় হাজার গ্রামবাসীর। স্নানের জন্য তাই ভরসা চাষের জল। ছবি: কিংশুক আইচ।
কেউ বলছেন এল নিনো। কেউ মনে করছেন উষ্ণায়ণ। চৈত্র পার করে মাঝ বৈশাখেও দেখা নেই কালবৈশাখির। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির নিচে নামছে না। ফসল ঝলসে যাচ্ছে। ছটফট করছে জলের মাছ। বিপর্যস্ত ধান, পাট, আম, লিচুর ভরা মরশুমও।
শেষ কবে বৃষ্টি হয়েছে মনে করতে গিয়ে নিজেই চমকে উঠলেন মায়াপুরের রূপেন বিশ্বাস। পাক্কা আড়াই মাস হতে চলল এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। দেখা নেই কালবৈশাখিরও। জলের অভাবে খটখটে মাঠে নেতিয়ে পড়া শাক-সব্জি, রোদ ঝলসানো বোরোধান ও পাটের চেহারা দেখে প্রমাদ গুনছেন প্রবীণ মানুষটি। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে গঙ্গার পাড়ে অল্প কয়েক বিঘা জমিতে ধান, পাট সহ প্রায় সব ধরনের চাষ আবাদ করা রূপেনবাবু বলছেন, “নদীর পাড়ে জমি হওয়ায় সেচের জল নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হয়নি কোনও দিন। কিন্তু এবার ভাবতে হচ্ছে। একে বৃষ্টি নেই তার উপর অস্বাভাবিক রোদের তাত। হু হু করে শুকিয়ে যাচ্ছে নদীর জল। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতায় এমন অবস্থা এর আগে কখনও দেখিনি। খুব দ্রুত বৃষ্টি না নামলে কপালে দুঃখ আছে।”
নদিয়া-মুর্শিদাবাদের যুগ্ম কৃষি অধিকর্তা হরেন্দ্রকুমার ঘোষ বলেন, “তাপমাত্রা সব সময় স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় সাত ডিগ্রি বেশি থাকছে। যার ফলে চাষআবাদের সামগ্রিক ছবিটাই বদলে গিয়েছে এবার। ধান, পাট থেকে আম, লিচু সব কিছুই জলের অভাবে এবং প্রবল তাপে বিপর্যস্ত।” জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ার যে দিক দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা গিয়েছে সেইসব এলাকার তাপমাত্রা সব সময়ে দুই থেকে তিন ডিগ্রির ফারাক থাকে। বাহাদুরপুর, মায়াকোল, ধুবুলিয়া, চৌগাছা, হাঁসাডাঙা-বনগ্রাম, আনন্দনগর, মধুপুরের মতো কর্কটক্রান্তিয় এলাকায় রবিবার তাপমাত্রার পারদ ৪৩ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল।
লাগামছাড়া তাপমাত্রা এবং বৃষ্টি না হওয়ার ফলে ধান থেকে পাট, মরশুমি সব্জি থেকে আম-লিচু এবারের আবহাওয়ায় কোনওটিই ঠিক মতো বেড়ে উঠতে পারছে না। বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কৃষক পরিমল দে বলেন, “এই প্রবল রোদের তাপে ধানে ‘চিটে’ লেগে যাচ্ছে। পোকার উপদ্রবে শেষ হয়ে যাচ্ছে পাট ও অনান্য সব্জি।”
ছাতা নিয়ে পাটের ক্ষেতে ব্যস্ত চাষি। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।
বর্ধমানের সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “এখনকার আবহাওয়া সব দিক থেকেই কৃষির প্রতিকূল। গড়ে ৪০ ডিগ্রির উপর তাপমাত্রা থাকায় ফুলের রেণু শুকিয়ে যাচ্ছে। পরাগ মিলন ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ফলন কমে যাবে। অন্য দিকে জলের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে গাছের বৃদ্ধি। বোরো ধানে এখন দানা পুষ্ট হওয়ার সময়। গরমে ধানের দানা পুষ্ট হওয়া দূরে থাক বেশির ভাগ ধানে চিটে ধরে যাচ্ছে। মার খাচ্ছে পাট, তিলের মতো অর্থকরী ফসলও।”
কৃষি অধিকর্তা হরেন্দ্রবাবু বলছেন, “বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি পাট বোনা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এবারে তা হয়নি। নদিয়ার ৬০ শতাংশ জমিতে পাট বসানো সম্ভব হয়েছে।” অন্য দিকে পার্থবাবু বলছেন, “বর্ধমানে কমবেশি ৫০ শতাংশ জমিতে এখনও পর্যন্ত পাট বসানো সম্ভব হয়েছে। তবে যাঁরা বুনেছেন তাঁরা পাট কীভাবে রক্ষা করবেন বুঝতে পারছেন না।” প্রাক্তন কৃষি আধিকারিক নিশীথকুমার দে বলেন, “এই গরমে ফসলে অনান্য সমস্যার সঙ্গে প্রবল হয়ে উঠেছে নানা ধরনের মাকড় এবং পোকার উপদ্রব। এই গরমে তারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে সব ধরণের ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সবচেয়ে ক্ষতি করছে পাটের। পোকায় পাট গাছের ডগা খেয়ে ফেলছে। বৃষ্টি না হলে এই সব মাকড় বা পোকা ধ্বংস করা মুশকিল।”
ফসল ও শাক-সব্জির পাশাপাশি এমন অবস্থার প্রভাব পড়ছে মাছের উপরেও। বারাসাত সরকারি কলেজের জীব বিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান এবং গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “মাছ সাধারণ ভাবে ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কিন্তু ৪০ ডিগ্রিতে মাছ জলের গভীরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এবারে তাপমাত্রা ৪১-৪২ ডিগ্রিতে টানা রয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি বৃষ্টি না হওয়ায় জলাশয়েও জল কমে গিয়েছে। এই অবস্থায় এমন কিছু বদল ঘটবে যা আগামি বর্ষায় মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলতে পারে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy