Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

জলাধার থেকেও পানীয় জল অমিল

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নদিয়ারাজের অনুগ্রহে রাজস্থান থেকে সিংহরায় পরিবারের কয়েকজন সদস্য এসে নাকাশিপাড়ায় থাকতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের সেই কয়েক ঘর জুড়ে গড়ে উঠেছিল এক ছোট জনপদ। তারপর যত দিন গিয়েছে বেড়েছে জনপদের কলেবর।

বেথুয়াডহরিতে অকেজো পিএইচই-র জলের কল।—নিজস্ব চিত্র।

বেথুয়াডহরিতে অকেজো পিএইচই-র জলের কল।—নিজস্ব চিত্র।

মনিরুল শেখ
নাকাশিপাড়া শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০৫
Share: Save:

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নদিয়ারাজের অনুগ্রহে রাজস্থান থেকে সিংহরায় পরিবারের কয়েকজন সদস্য এসে নাকাশিপাড়ায় থাকতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের সেই কয়েক ঘর জুড়ে গড়ে উঠেছিল এক ছোট জনপদ। তারপর যত দিন গিয়েছে বেড়েছে জনপদের কলেবর। ধীরে ধীরে নাকাশিপাড়ার অদূরেই জাতীয় সড়ক ও রেল স্টেশন গড়ে ওঠে। বাড়তে থাকে শহরের জনসংখ্যা। তবে শুধুই শহরের জনসংখ্যা বা কলেবর নয়, বিগত কয়েক বছরে বেড়েছে নানা সমস্যাও। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব।

শহরের দক্ষিণপ্রান্তে কাশিয়াডাঙায় রয়েছে গঙ্গার জল পরিশোধন কেন্দ্র। পাইপ দিয়ে সেই জল শহরের সর্বত্র পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কই? শহরবাসীরা একটু পানীয় জলের জন্য মাথা কুটে মরছেন। অভিযোগ, বারবার সমস্যার সমাধানের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পানীয় জলের জন্য হাহাকার যেন এ শহরের রোজনামচা।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের তথ্য অনুযায়ী নদিয়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা আর্সেনিকপ্রবণ। নাকাশিপাড়াও সেই এলাকার মধ্যে পড়ে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে নাকাশিপাড়ার ব্লক প্রশাসন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, শহরের একশোটি নলকূপের মধ্যে অন্তত সাতাশটিতে আর্সেনিক বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে। সাধারণত প্রতি লিটার জলে .০১ থেকে .০৫ মিলিলিটার পর্যন্ত আর্সেনিক মানবশরীরে গেলে কোনও ক্ষতি হয় না। কিন্তু ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, নাকাশিপাড়ায় জলে আর্সেনিকের সর্বোচ্চ মাত্রা ধরা পড়েছে .২৯ মিলিলিটার।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দশক আড়াই আগে নাকাশিপাড়ায় ভূগর্ভস্থ জল তুলে শোধন করে পাড়ায় পাড়ায় তা পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হত। এমনকী নাকাশিপাড়ায় অভয়ারণ্যের পাশে ২ লক্ষ ৭৩ হাজার লিটার জলধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি জলাধারও সেই কারণে তৈরি করা হয়। কিন্তু পরে জলে আর্সেনিক ধরা পড়ায় ভূগর্ভের বদলে শহরে ভূপৃষ্ঠের জল সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাকাশিপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে দিয়েছে গঙ্গা। ঠিক হয় গঙ্গার জলই পরিশোধন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জল সরবরাহ করা হবে। সেই মতো ২০০৫ সালে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর প্রায় ৯০ কোটি টাকা খরচ করে কাশিয়াডাঙায় গঙ্গার জল পরিশোধন কেন্দ্র গড়ে তোলে। ২০১১ সালে অক্টোবরে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ঘটা করে ওই জল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। কেন্দ্রটি দেখভালের জন্য একটি বেসরকারি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়। শহরবাসীর অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা খরচ করে ওই প্রকল্প চালু হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শহরের প্রাণকেন্দ্র বেথুয়াডহরির বেশিরভাগ মানুষই বঞ্চিত পরিস্রুত পানীয় জল থেকে। একই সমস্যায় পড়েছেন শহরতলির বাসিন্দারাও। এই মুহূর্তে বেথুয়াডহরির বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও হরিতলা, স্টেশন রোড, সাহাপাড়া, জুুগপুর কলোনির ট্যাপগুলিতে নিয়মিত জল মেলে না। পানীয় জল না মেলায় শহরবাসী বাধ্য হচ্ছেন আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের জল পান করতে। সাধ্য থাকলে কেউ কেউ চড়া দামে কিনে খাচ্ছেন মিনারেল ওয়াটার।

স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “নামেই ট্যাপ। প্রায় দিন পনেরো হতে চলল এক ফোঁটাও জল পড়ছে না। আবার মাঝেমাঝে যদিও বা মেলে তা সরু সুতোর মতো পড়ে।”

কিন্তু কেন ওই সমস্যা?

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের দাবি, কাশিয়াডাঙায় ওই প্রকল্পের জল পুরোনো পাইপের মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ওই পাইপ সিমেন্টের তৈরি। প্রায় আড়াই দশক আগে বসানো ওই পাইপ কোথাও কোথাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রায়ই মাটি খুঁড়ে সেই পাইপ মেরামত করতে হয়। ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকায় জল সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে।

দফতরের কর্তাদের দাবি, বেথুয়াডহরি স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় শিয়ালদহ-লালগোলা রুটের ডবল লাইন পাতার কাজ চলছে। সেই কারণে লোহা-লক্কড় ভর্তি লরি যায় স্টেশন রোড দিয়ে। তার কারণে মাত্র দু’ফুট নীচে পোঁতা ওই সিমেন্টের জলের পাইপ লরির চাপে প্রায়ই ফেটে যাচ্ছে। জুগপুর কলোনিতে জল না মেলার কারণ হিসেবে দফতরের কর্তাদের যুক্তি, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে জল প্রকল্পের পাইপ রয়েছে। জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জন্য কলোনির জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেই কারণে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে থাকা পাইপ তুলে ফেলা হয়েছে। যার ফলে ওই কলোনিতে কয়েক হাজার মানুষকে বিশুদ্ধ পানীয় জলের পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি দফতরের কর্তাদের।

জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের বাস্তুকার সন্দীপ সরকার বলেন, “নাকাশিপাড়া এলাকায় জলের পাইপ সারানোর কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। সেই সঙ্গে যাতে ঘন ঘন পাইপ ভেঙে না যায় তার জন্য লোহার পাইপ বসানো হবে।” কিন্তু কবে সেই কাজ শুরু হবে সেই আশায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই শহরবাসীর কাছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE