জঙ্গিপুর হাসপাতালে সাকিনা বিবি। —নিজস্ব চিত্র
স্বামীকে পছন্দ নয় তার। তাই প্রায়ই সে রেগে থাকত। আর রাগ চড়লেই ধরে পেটাত তিন ছেলেমেয়েকে।
শেষমেশ দুই ছেলেকে গলা টিপে মেরে নিজের হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগ উঠল জঙ্গিপুরের জয়রামপুর বাঁধ পল্লির ওই তরুণীর বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা নাগাদ সাকিনা বিবি নামে বছর পঁচিশের ওই তরুণীকে জঙ্গিপুর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তার আগেই মৃত্যু হয়েছে আলিম শেখ (৩) ও সেলিম শেখ (দেড় বছর) নামে তার দুই ছেলের। বড় মেয়ে, পাঁচ বছরের রিমা খাতুন ওই সময়ে স্কুলে থাকায় বেঁচে যায়।
এমন কিছু যে ঘটতে পারে তা আগেই আন্দাজ করেছিলেন সাকিনার শাশুড়ি বেলেনুর বিবি। বাড়িতে এখন কোনও পুরুষ নেই। সাকিনার স্বামী রমজান শেখ, দেওর, শ্বশুর সকলেই রাজমিস্ত্রির কাজে ঝাড়খণ্ডে গিয়েছেন মাসখানেক হল। সকালেই বেলেনুর ছুটেছিলেন ইছাখালি বাবুপুরে সাকিনা বিবির বাপের বাড়িতে। সাকিনার মা, দিদিমা ও বোন তাঁর সঙ্গে রওনাও দিয়েছিলেন। তাঁরা যখন মাঝপথে, তখনই দুঃসংবাদ পান।
কেন সাকিনার বাপের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন তার শাশুড়ি?
বেলেনুরের অভিযোগ, “একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লেই সাকিনা ছেলেমেয়েদের অকারণ মারর শুরু করত। সোমবার সকাল থেকেই ফের শুরু হয়েছিল। বেশ কয়েক বার আমি নিজে গিয়ে তাকে থামাই।” তাঁদের টালির বাড়ির তিনটি ঘরে সাকিনা, তাঁর ছোট জা নার্গিস এবং শাশুড়ি থাকেন। বেলেনুরের কথা অনুযায়ী, সন্ধ্যায় সাকিনা ফের মারমুখী হয়ে উঠলে রিমা দৌড়ে পালায়। বাকি দু’টি শিশু পালানোর মতো বড় হয়নি। বেলেনুর আর নার্গিস ছুটে গিয়ে তাদের মারের হাত থেকে বাঁচান।
মঙ্গলবার ভোর হতেই বেলেনুর ছোটেন সাকিনার বাপের বাড়িতে খবর দিতে। সাকিনার বাবা হান্নান শেখও এখন রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে চেন্নাইয়ে রয়েছেন। তার মা, দিদিমা ও বোনকে বিপদের কথা জানিয়ে তাঁদের নিয়ে জয়রামপুরের পথে ফিরছিলেন বেলেনুর। মাঝরাস্তাতেই সাকিনার মা জাহানুর বিবির মোবাইলে ফোন আসে। শোনেন, দুই ছেলেকে গলা টিপে মেরে ইট দিয়ে নিজের কপাল ফাটিয়ে হাতের শিরা কেটে মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। কাঁদতে-কাঁদতে সেখান থেকেই বাড়ি ফিরে যান জাহানুর। দিদিমা হালেমা বিবি আর বোন সাখিনা যান হাসপাতালে।
সাকিনা কি ছোটবেলা থেকেই উগ্র প্রকৃতির?
হালেমা বিবি বলছেন, ‘‘ও মেয়ে বরাবরই খুব রাগী আর জেদি। বাড়ির সবাই ভেবেছিল, বিয়ে করে সংসারী হলে রাগ কমবে। কিন্তু বিয়ের ছ’বছর কেটে গেল। রাগ কমার বদলে যেন আরও উগ্র হয়ে উঠেছে। একটুতেই ছেলেমেয়েগুলোকে ধরে পেটাত।’’ তাঁর মতে, আসলে বিয়ে নিয়ে অখুশি ছিল সাকিনা। ‘‘বলত, বিয়ে ভেঙে দিয়ে ফের ভাল ঘরে বিয়ে দিতে। আমরা বোঝাতাম, তিনটে ছেলেমেয়ে রয়েছে, তাদের কী হবে? এই পরিণতি হবে, কে জানত?”— কপাল চাপড়ান হালেমা বিবি।
সাকিনার হতাশা আর মানসিক অস্থিরতার কথা জানতেন পড়শিরাও। প্রতিবেশী নাজিবুল শেখের বক্তব্য, “সব বাবা-মা ছেলেমেয়েদের শাসন করে। কিন্তু মা হয়ে ছেলের গলা টিপে মারতে পারে কেউ?’’ তাঁর দাবি, মাসখানেক আগেও এক বার বঁটি দিয়ে হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করে সাকিনা। ক্ষত গভীর ছিল না বলে সে যাত্রা বেঁচে যায়।
গোটা ঘটনায় প্রতিবেশীরা এতটাই ক্ষুব্ধ যে সাকিনা রক্তাক্ত অবস্থায় দীর্ঘ ক্ষণ বারান্দায় পড়ে থাকলেও কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। পুলিশের অনুরোধেও কেউ এগিয়ে আসেননি। হতবাক জাহানুর বিবি বলছেন, ‘‘শ্বশুরবাড়ি পছন্দের না-ই হতে পারে, তা বলে কেউ নিজের মা ছেলেদের খুন করতে পারে? অমন মেয়ের মুখদর্শন করতে চাই না। তাই হাসপাতালেও যাইনি।”
পাঁচ বছরের রিমাকে অবশ্য নিয়ে যেতেই হয়েছে তার মায়ের কাছে। স্কুল থেকে ফিরে পুলিশ দেখেই ভয়ে সে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিল। তার পরে মাকে না দেখে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। বাধ্য হয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই মাসি সাখিনার পাশে বসে সে বলে, ‘‘মা রেগে গেলে খুব মারত। আমি ভয়ে পালিয়ে যেতাম ঠাকুমার কাছে। কিন্তু ভাইয়েরা পালাতে পারত না, তাই মার খেত।’’
সন্ধ্যে পর্যন্ত কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না সাকিনা। জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “ওঁকে পুলিশি হেফাজতে চিকিৎসায় করানো হচ্ছে। কেন, কী ভাবে কী ঘটেছে তা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে। দুই বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy