সাগরদিঘির দিয়াড় বালাগাছি জুনিয়র হাইস্কুলে ক্লাস নিচ্ছেন গ্রামের মেয়েরাই। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ যে বছর থেকে বন্ধ হয়েছে, সেই বছরেই চালু হয়েছিল স্কুলটি।
শিক্ষকের অভাব মেটাতে হাইস্কুল থেকে অবসর নেওয়া তিন শিক্ষককে ‘অতিথি শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ করে কাজ চালানো হচ্ছিল। তাঁরাও একে-একে ৬৫ বছরের বয়ঃসীমা পেরিয়ে গিয়েছেন।
ইতিমধ্যে ক্লাস বেড়েছে। বেড়েছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। শিক্ষক সংখ্যা এক জনে এসে ঠেকার পরে স্কুল বাঁচাতে গ্রামেরই পাঁচ তরুণ-তরুণী বিনা বেতনে পড়াতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ শিক্ষকও অবসর নিয়েছেন গত ডিসেম্বরে। ফলে একেবারেই বন্ধ হতে বসেছে সাগরদিঘির দিয়াড় বালাগাছি জুনিয়র হাইস্কুল। মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এলাকার এই স্কুলটির পড়ুয়া সংখ্যা বর্তমানে ১৫১, যার ৭০ শতাংশই ছাত্রী। দোতলা স্কুলবাড়ি, আলাদা অফিস ঘর, মিড-ডে মিল রান্নার ঘর, ছ’টি শৌচাগার —কিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু শিক্ষকের। ‘অতিথি শিক্ষক’ চেয়ে পথে-ঘাটে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই আগ্রহী হননি। গ্রামের লোকজন বিনা বেতনে পড়িয়েও স্কুল বাঁচাতে মরিয়া। কিন্তু খাতায়-কলমে অন্তত এক জন শিক্ষক না থাকলে সেই স্কুল চালানো যায় না।
কেন এই অবস্থা? রাজ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ বন্ধ সেই ২০০৯ থেকে। ওই বছরই চালু হয়েছিল স্কুলটি। শিক্ষকের অভাব মেটাতে গাঁ-গঞ্জের এ রকম বহু জুনিয়র হাইস্কুলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ‘অতিথি শিক্ষক’ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। যে বেতনে হাইস্কুল থেকে অবসর নিয়েছেন, তার থেকে পেনশনের টাকাটুকু কেটে নিয়ে বাকি টাকা বেতন হিসেবে দেওয়া হত। পেনশন তাঁরা আলাদা পেতেন। অর্থাৎ কার্যত শেষ পাওয়া বেতনের গোটা টাকাটাই হাতে পেতেন তাঁরা। ৬৫ পেরোলে পুরোপুরি অবসর।
কিন্তু ২০১৩ সালে রাজ্যের শিক্ষা দফতর নতুন নির্দেশিকা জারি করে জানায়, অতিথি শিক্ষকদের আর এই বেতন দেওয়া যাবে না। যাঁরা স্নাতক, তাঁরা মাসে পাঁচ হাজার এবং যাঁরা স্নাতকোত্তর, তাঁরা মাসে সাত হাজার টাকা করে পাবেন। শিক্ষকের অভাব থাকায় প্রাথমিক স্কুল থেকে অবসর নেওয়া স্নাতকেরাও পড়াতে পারবেন বলে জানানো হয়। কিন্তু এই বেতনে কাজ করতে, স্কুলে পড়ানো থেকে মিড-ডে মিল পর্যন্ত হাজার হ্যাপা সামলাতে বেশির ভাগ বৃদ্ধ শিক্ষকই উৎসাহ পাচ্ছেন না। ফলে ‘অতিথি শিক্ষক’ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
এই সঙ্কটের মধ্যে পড়ে অনেক জুনিয়র হাইস্কুলেরই নাভিশ্বাস উঠেছে ইতিমধ্যে। জঙ্গিপুর মহকুমা সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক পঙ্কজ পাল জানান, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে রঘুনাথগঞ্জ ২ ব্লকেও রঘুনাথপুর জুনিয়র হাইস্কুল তুলে দিতে হয়েছে। সাগরদিঘির গাঙ্গাড্ডা জুনিয়র গার্লস, কৈয়র জুনিয়র গার্লস, ইসলামপুর জুনিয়র হাইস্কুল গত বছর অনুমোদন পেয়ে গেলেও খোলা যায়নি।
বহু মাথা খুঁড়েও শিক্ষক না মেলায় গত বছর জানুয়ারিতে তালা পড়েছে সাগরদিঘির রামনগর জুনিয়র হাইস্কুলে। গ্রামবাসীরা টানা সাত দিন বিক্ষোভ দেখানোর পরে শেষ পর্যন্ত শ’তিনেক ছাত্রছাত্রীকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে বালিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে মান বাঁচাতে হয়েছিল জেলা শিক্ষা দফতরকে। বালিয়ার রামনগরে ঘটেছে একই ঘটনা। কিন্তু দিয়াড় বালাগাছির নয় কিলোমিটারের মধ্যে তেমন কোনও হাইস্কুলও নেই।
ঘটনাচক্রে, জন্মলগ্ন থেকেই ক্রমশ সঙ্কটের আবর্তে জড়িয়ে গিয়েছিল স্কুলটি। গত ছ’বছরে আড়ে-বহরে যত বেড়েছে স্কুল, সঙ্কট তত ঘোরালো হয়েছে। প্রথম বছর চালু হয়েছিল শুধু পঞ্চম শ্রেণি, দায়িত্বে তিন শিক্ষক। পরের তিন বছরে পর্যায়ক্রমে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্ট শ্রেণি চালু হয়েছে। ক্লাস বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। শিক্ষকের সংখ্যা তো বাড়েইনি, উল্টে কমতে থেকেছে। ২০১৪ সালে একে শিক্ষকে এসে ঠেকায় গ্রামবাসীদের অনুরোধে পাঁচ তরুণ-তরুণী বিনা বেতনে পড়াতে শুরু করেন। শেষ সরকারি শিক্ষক মহম্মদ আসাদুল্লা খাতাপত্রে সই-সাবুদের কাজ করতেন, বাকি কাজ চালাতেন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষকেরা। জানুয়ারি থেকে তা-ও বন্ধ।
দিয়াড় বালাগাছিতে স্কুলের চাহিদা বস্তুত অনেক দিনের। গ্রামের বাসিন্দা জুলফিকার আলি দেওয়া ১৬ শতক জমিতে তাই গড়ে তোলা হয়েছিল স্কুলটি। যে পাঁচ জন বিনা বেতনে স্কুলে পড়াচ্ছিলেন, তাঁদের এক জন খোশ মহম্মদের কথায়, ‘‘প্রত্যন্ত এই গ্রামে দু’টি প্রাথমিক স্কুল আছে। কিন্তু হাইস্কুল না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি থেকেই স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছিল। তা আটকাতেই এই স্কুলটি সগড়ে তোলা হয়।’’
গ্রামেরই বধূ, সংস্কৃতে স্নাতক গুড়িয়া বিবি ও স্নাতকোত্তীর্ণ সাবিনা খাতুন বলেন, ‘‘ছাত্র ভর্তি, থেকে মিড-ডে মিল বা বই বণ্টন সবই আমরা চালাতাম শিক্ষকের বকলমে। তিনি না থাকায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের এ বার পরের ক্লাসে ভর্তি করা যায়নি। সরকারি পাঠ্যপুস্তক মেলেনি, রান্নাঘর বন্ধ, খাতাপত্র নেই, হাজিরার বালাই নেই। স্কুল যাতে উঠে না যায়, তার জন্য আমরা পড়িয়ে যেতে রাজি। কিন্তু সরকারি ভাবে এক জন শিক্ষক তো অন্তত পেতে হবে!’’ এমনকী, পাশের কোনও স্কুল থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সপ্তাহে দু’তিন দিন কোনও শিক্ষককে পাঠালেও তাঁরা কাজ চালিয়ে নেবেন বলে ওই তরুণ-স্বেচ্ছাসেবীরা স্কুল পরিদর্শককে জানিয়েছেন। কিন্তু তা-ও মেলেনি।
বুধবার স্কুলে গিয়ে দেখা মিলেছে শিক্ষাবন্ধু শাদরুল আমিনের। তাঁ আক্ষেপ, ‘‘স্কুল পরিদর্শকের নির্দেশে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বহু মাধ্যমিক ও স্নাতকে উত্তীর্ণ প্রাথমিক শিক্ষককে অনুরোধ করেছি স্কুলের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু কেউ রাজি হন নি।’’ স্কুলটির সভাপতি, সাগরদিঘি পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য কিনার হোসেনের অভিযোগ, ‘‘বহু বার বলা সত্ত্বেও শিক্ষা দফতরের কর্তারা ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্কুল উঠে যেতে বসেছে।’’
শিক্ষা দফতর কেন নিষ্ক্রিয়?
সাগরদিঘির অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক জয় চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘সমস্যার কথা জেলা শিক্ষা দফতরে জানানো হয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষক মিলছে না। ওখানে আবার ধারে-কাছে অন্য স্কুলও নেই।’’ শিক্ষক সঙ্কটের কথা মেনে নিয়ে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক পূরবী দে বিশ্বাস বলেন, ‘‘দিয়াড় বালাগাছির স্কুলটি যাতে চালু রাখা যায় তার জন্য বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চলছে। ওই এলাকার কিছু শিক্ষক অন্য স্কুলে কর্মরত। কিন্তু তাঁদের হাইস্কুল থেকে তুলে ওই স্কুলে পাঠানো আমার ক্ষমতার বাইরে।’’
জেলার শিক্ষক ও শিক্ষা দফতরের কর্মীদের একটা বড় অংশ এর জন্য রাজ্য সরকারকেই দুষছেন। সিপিএম প্রভাবিত শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ-র জেলা সম্পাদক দুলাল দত্তের মতে, ‘‘রাজ্য সরকারের ভ্রান্ত নীতির জন্যই এই শিক্ষক সঙ্কট। তারই পরিণতি একের পর এক জুনিয়র হাইস্কুলে ঝাঁপ পড়া।’’ তৃণমূল অনুগামী মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির জেলা সভাপতি শেখ ফুরকানও মেনে নেন, ‘‘পাঁচ হাজার টাকায় কেউ অতিথি শিক্ষক হয়ে যেতে চাইছেন না । নতুন শিক্ষক নিয়োগও অনিশ্চিত। তাতেই সমস্যা বাড়ছে।’’ শাসক দলের অনুগামী হয়েও তাঁরা কেন সরকারের উপরে চাপ দিচ্ছেন না? নেতার বক্তব্য, ‘‘আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে মন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়েছে। আগামী ২৫ জানুয়ারি হাওড়ার শরৎ সদনে আমাদের রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।’’
শুকনো আলোচনায় যে চিঁড়ে ভিজবে না, তা কে না জানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy