যে কোনও উপায়ে ‘গড়ে’ বড়সড় আঘাত হানতে হবে। না হলে আর আরও বড় প্রাপ্তির শিকে হয়তো ছিঁড়বেই না, বরং অপেক্ষা করছে ‘অবনমন’—পুরভোটের আগে মুর্শিদাবাদে গুঞ্জন এমনটাই।
পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা—এখনও অবধি কোনও ভোটেই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ‘খাসতালুক’ মুর্শিদাবাদে সে ভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি রাজ্যের শাসক দল। ব্যর্থতার সেই লজ্জা ঢাকতে এ বারের পুরভোটে ‘মুর্শিদাবাদ ব্রিগেড’ গড়ে ময়দানে নেমেছে তৃণমূল। ব্রিগেডে রয়েছেন তমলুকের সাংসদ তথা জেলা পর্যবেক্ষক শুভেন্দু অধিকারী। বাকি দু’জন গায়ক-নেতা ইন্দ্রনীল সেন এবং মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন স্বয়ং। রণকৌশল ঠিক করতে গত ২৮ মার্চ বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে কর্মিসভা করেন তিন জন। সেখানে ইন্দ্রনীলকে বলতে শোনা যায়, “আমার ব্যর্থতার জন্যে গত লোকসভা নির্বাচনে বহরমপুর লোকসভা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিতে পারিনি। তবে এ বার পুরসভাগুলি তাঁর হাতে তুলে দেব।”
কী ভাবে তা সম্ভব, তা-ও ইঙ্গিতে খোলসা করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ওই মঞ্চ থেকেই প্রাক্তন বিধায়ক নিয়ামত শেখ, সত্যেন চৌধুরী বেলডাঙা পুরসভার, রঘুনাথগঞ্জ ব্লক সভাপতি মঞ্জুর আলি ও ইলিয়াস শেখকে জঙ্গিপুর পুরসভার, বড়ঞার আফাজ, গোরাই, জর্জ, নুর ইসলাম ও হাতেম শেখের উপর কান্দি পুরসভার ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব বণ্টনের পরে তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন ইন্দ্রনীল বলেছিলেন, ‘‘যত শক্তি আছে, কাজে লাগাবে। তোমরা অন্য বলও কাজে লাগাও!” প্রসঙ্গত, দায়িত্বপ্রাপ্তদের সকলেই এক সময়ের অধীর-ঘনিষ্ঠ বাহুবলী হিসাবে আমজনতা থেকে পুলিশের খাতায় পরিচিত। প্রায় বারো বছর আগে জ্ঞানবন্ত সিংহ মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার থাকার সময় অধীর শিবিরের আনুগত্য ছেড়ে তাঁরা বিরোধী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেই ‘অন্য বল’ ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কংগ্রেস, সিপিএমের মতো বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা পুরসভাগুলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করছে। পুলিশকে বহুবার অভিযোগ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না!’’ ফলে পুর-প্রচারের শেষ দিকে বিরোধীরা সুর চড়িয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের মদতে শাসক দলের পুর-সন্ত্রাস নিয়ে। একই সঙ্গে, কলকাতার পুরভোট থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে পাল্টা রণকৌশল নিয়েছে বিরোধীরাও। কেমন?
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী খোলাখুলিই বলছেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাস যে ভাবেই হোক আটকাবো। পুলিশ প্রশাসনের উপরে আমাদের কোনও ভরসা নেই। ভোটের দিন তৃণমূল সন্ত্রাস করলে দলের কর্মী-সমর্থকেরা প্রতিরোধ করবেন।’’ কংগ্রেসের মতো সিপিএমও শাসক দলের সঙ্গে যুঝতে বুথস্তরে কোর গ্রুপ গড়েছে বলে জানা গিয়েছে। সিপিএমের একটি সূত্রে খবর, সেই সব কোর গ্রুপেও থাকছে সমানে টক্কর দেওয়ার মতো উঠতি বাহুবলির দল। ফলে পুরভোটের দিনে জেলায় কত রক্ত ঝরবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পুলিশও উদ্বিগ্ন। কারণ শাসক দল রাজ্যের সর্বত্র ওয়াক ওভার পেলেও এ জেলায় টক্কর অবশ্যম্ভাবী। এ বিষয়ে মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার শুধু বলেন, ‘‘পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নই নেই। সব রকম পরিস্থিতির জন্যে জেলা পুলিশ তৈরি।’’
তবে, এ বারের ভোটে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে বাড়তি তৎপরতা রয়েছে। দলনেত্রীর নির্দেশ, মুর্শিদাবাদে ভাল ফল করতে হবে। নেত্রীর সেই কথা রাখতে মরিয়া নেতারা। এ দিকে, মুর্শিদাবাদ পুরসভার ক্ষেত্রে জেলা তৃণমূল সভাপতি মান্নান হোসেন ও যুব কংগ্রেসের রাজ্য নেতা মান্নান-পুত্র সৌমিক হোসেনের ‘প্রেস্টিজ ফাইট’। পুরসভার ভোটের ফলাফল তৃণমূলের অনুকূলে আনতে না পারলে জেলা সভাপতির পদ শুধু নয়, আগামী লোকসভা ভোটে টিকিট পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে তৃণমূলেরই একটি সূত্রে খবর। একই ভাবে আগামী বিধানসভা ভোটে টিকিট পেতে মরিয়া মান্নান পুত্র সৌমিক হোসেনও মুর্শিদাবাদ পুরভোটে জিততে চান। জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল রয়েছেন কান্দি পুরভোটের দায়িত্বে। আগামী বিধানসভা ভোটে কান্দি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হতে চান তিনি। ফলে পুরভোটে কিছু করে দেখানোর তাগিদ রয়েছে তাঁরও।
তবে তৃণমূলের হুমায়ুন কবীর নিজের ভূমিকা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘পুরভোটে আমার কোনও ভূমিকা নেই। বাড়িতে বসে চুপ করে সব দেখছি।’’ কিন্তু দলের অন্দরের খবর, ইন্দ্রনীলের হাতে ‘অপমানিত’ হয়ে হুমায়ুন তাঁর অনুগামীদের ‘নিষ্পৃহ’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, হুমায়ুনের রাজনৈতিক জীবনে ফের আশার আলো জ্বালাতে পুরভোটের ফল অবশ্যই তৃণমূলের বিপক্ষে যেতে হবে।
এমনই নানা সমীকরণে কোনঠাসা তৃণমূল ‘সন্ত্রাসের’ আবহে ভোট নিজেদের পক্ষে করতে চাইছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। কেননা, ফলাফলের নিরিখে মুর্শিদাবাদ জেলার ছ’টি পুরভোটে কোথাও বাম, কোথাও কংগ্রেস এগিয়ে! ভোটের দিন সন্ত্রাস চালাতে ওই ৬টি পুর এলাকায় তৃণমূল বাইরে থেকে দুষ্কৃতী আনছে বলেও অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
ফলে পুলিশ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভাবে ভোট হবে আশ্বাস দিলেও ভোটের দিন যে কী হবে তা নিয়ে সংশয় সব মহলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy