Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

কোন ‘পাপে’ নাম গেল কাটা, জানে না দেউলি

শিশির মাঝি তাঁদেরই একজন। সদ্য বাষট্টিতে পড়লেন। বাড়িতে তাঁর ৮৫ বছরের বৃদ্ধা মা পা ভেঙে পড়ে রয়েছেন। বিপিএল না থাকায় নিখরচায় চিকিৎসাও থমকে। টালির ঘরে বসে উপরে চাইলেই অর্ধেক আকাশ চোখে পড়ে। ছেলে ও মা কারোরই জোটেনি বার্ধক্য কিংবা বিধবা ভাতা।

নিজের ভাঙা বাড়ি দেখাচ্ছেন দেউলির এক বৃদ্ধ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

নিজের ভাঙা বাড়ি দেখাচ্ছেন দেউলির এক বৃদ্ধ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৮ ০২:৪৩
Share: Save:

আস্ত গ্রামটাই বাদ পড়ে গিয়েছে বিপিএল তালিকা থেকে।

গ্রামের সোজা রাস্তাটা যেখানে পুকুর পাড়ে বাঁক নিয়েছে, ছোট্ট পাড়াটা সেখানেই, চলতি নাম মজুর-পাড়া। তবে, ১৭৯টি দিনমজুর পরিবারের কারও নামই বিপিএল তালিকায় ঠাঁই পায়নি। সরকারি সব সুবিধাই তাদের কাছে বিজ্ঞাপনের মতো, দূরের অধরা একটা স্বপ্ন।

ষাট পার করা বয়স্কের সংখ্যাও অন্তত ৪৫। বিধবার সংখ্যা একশোর বেশি। অথচ তাঁদের বরাতেও জোটেনি সরকারি ভাতার সাহায্য। সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা প্রাপকের তালিকাতেও নাম নেই কারও। তাঁদের প্রাপ্তি বলতে, রাজ্য সরকারের দেওয়া কার্ডে ২ টাকা কিলো দরে কয়েক কেজি চাল। মজার ব্যাপার, সে কার্ডও সকলের নেই।

রঘুনাথগঞ্জ ১ ব্লকের কানুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের দেউলি গ্রামের এটাই সংক্ষিপ্তসার। অথচ, ২০০২ সালে ১৭৯ জন পরিবারের সকলের নামই ছিল বিপিএল তালিকায়। কিছু কিছু সরকারি সুবিধাও জুটেছিল তাঁদের।

শিশির মাঝি তাঁদেরই একজন। সদ্য বাষট্টিতে পড়লেন। বাড়িতে তাঁর ৮৫ বছরের বৃদ্ধা মা পা ভেঙে পড়ে রয়েছেন। বিপিএল না থাকায় নিখরচায় চিকিৎসাও থমকে। টালির ঘরে বসে উপরে চাইলেই অর্ধেক আকাশ চোখে পড়ে। ছেলে ও মা কারোরই জোটেনি বার্ধক্য কিংবা বিধবা ভাতা।

৬৫ বছরের ব্রজবালা মাঝির স্বামী মারা গেছেন বহু আগেই। ৬ জনের পরিবারে ২ টাকা কিলোর চাল পাননি তিনি। ব্রজবালা বলছেন, “বিপিএল বলেই জানতাম নিজেকে। সরকারি আবাসনের জন্য পঞ্চায়েতে আবেদন করতে গিয়েই জানলাম নাম কাটা পড়েছে। কেন? উত্তর পেলাম
না বাবা!’’

দশ বছর আগে মারা গিয়েছেন চায়না মাঝির স্বামী। ছেলেরা দেখে না। এখন টালির ঘরে থাকেন একাই। বলছেন, “অন্যের বাড়ি পরিচারিকার কাজ করি। ২ টাকা কেজির চালটা পাই। খেয়ে না খেয়ে চালাতে হয়। বিধবা ভাতা চেয়ে তিন বার আবেদন করেছি পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে। প্রতিবারই শুনেছি, এ বার হয়ে যাবে!’’

তালিকাটা এমনই দীর্ঘ। ১৪ বছর আগে বিধবা হয়েছেন টুকটুকি মাঝি। স্বামীর গড়া মাটির বাড়িটাই তাঁর সম্বল, না বিধবা ভাতা-টাতা কিচ্ছু পান না তিনি। তাঁর গলাতেও ক্ষোভ, ‘‘আর কত বার আবেদন করব বাবা, ভাল লাগে না!’’ শকুন্তলা মাঝি বলছেন, ‘‘স্বামী মারা গেল, ভাতা পেলাম না। ভাবলাম বিপিএল তালিকায় তো আছি তাই যাচাই করতে গিয়েছিলাম। ও মা, দেখি সেখানেও নাম
কাটা গিয়েছে!’’

৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী হয়ে শয্যাশায়ী অভয় মাঝি। স্ত্রীও মারা গেছেন তিনটি শিশুকে রেখে। ২০০২ সালের বিপিএল তালিকার ১৭২ নম্বরে নাম ছিল তাঁর। তবে নতুন তালিকায় আর জায়গা হয়নি। বলছেন, ‘‘কী পাপ করেছি বলুন তো!’’

পঞ্চায়েত সদস্য নিশীথ মণ্ডল বলছেন, “কী ভাবে এমন একের পর এক নাম কাটা গেল বুঝতে পারছি না। আমি তো জানি ওঁরা সকলেই দিনমজুর। বিডিও’র কাছে আমিও তো দু’বেলা দরবার করছি।’’ রঘুনাথগঞ্জ ১ বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলছেন, ‘‘কেন এমনটা হল তা খোঁজ নিচ্ছি। তার বেশি আর কী বলব!’’

সত্যিই তো, কী-ই বা বলবেন!

অন্য বিষয়গুলি:

BPL List Dropped Village
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE