দখলদারদের কবলে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। ছবি: প্রণব দেবনাথ
দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে আবার নতুন করে শুরু হতে চলেছে কৃষ্ণনগরের কাছে বাহাদুরপুর থেকে বড় জাগুলিয়া পর্যন্ত জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ। কিন্তু কাজ শুরুর আগে আশঙ্কা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অধিগৃহীত জমির যে বিরাট অংশ জবরদখল হয়ে আছে, প্রশাসন তা দখলমুক্ত করবে কী ভাবে।
অনেকেই মনে করছেন, এ বার যদি কোনও ভাবে ফের জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের কাজ আটকে যায়, গোটা কাজটাই অনিশ্চিত হয়ে যাবে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের এক আধিকারিকের কথায়, “জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যার জেরে একটি সংস্থা আগেই কাজ না করে চলে গিয়েছে। এ বার অনেক কষ্ট করে আর একটি সংস্থাকে নিয়ে আসা হয়েছে। এ বারও একই কারণে কাজ আটকে থাকে, মনে হয় না, এর পরে আর কোনও সংস্থা এগিয়ে আসবে।”
পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। বুঝতে পারছে শাসক দলও। কারণ এই অংশের কাজ আটকে থাকায় শুধু নদিয়ার মানুষই নয়, উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বহু মানুষ নিয়মিত বিপাকে পড়ছেন। কারণ এই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কই কলকাতা ও পূর্ব ভারতের প্রধান সংযোগকারী রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহণ করা হয়। অথচ কৃষ্ণনগর থেকে বড় জাগুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিলোমিটার রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ আটকে আছে।
এই আটকে থাকার অন্যতম বড় কারণ, জমির বেআইনি দখল। তা দখলমুক্ত করতে না পারলে এ বারও কাজ বিশেষ এগোনোর আশা নেই। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, এই অংশে বড় জাগুলিয়া, চাকদহ, রানাঘাট, শুকপুকুরিয়া, হবিবপুর, বেলগড়িয়া, গোবিন্দপুর ও দিগনগর মিলিয়ে প্রায় ২১ কিলোমিটার রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি বেআইনি ভাবে দখল হয়ে আছে। তার মধ্যে প্রায় চোদ্দশো বাড়ি ও দোকানঘর আছে। এর মধ্যে জনা পাঁচশো জমির মালিক, যাঁদের কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা নেননি, আবার কেউ-কেউ টাকা নিয়েও জমি ছাড়েননি। আর বাকি ন’শোর নিজের জমি নেই। বেআইনি ভাবেই তাঁরা জমি দখল করে আছেন। তাঁদের নিয়েই সমস্যা বেশি।
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁরা নির্ধারিত আর্থিক মূল্যের প্রায় ৯৯ শতাংশ টাকা জেলা প্রশাসনকে দিয়ে দিয়েছেন। আবার জেলা প্রশাসন দাবি করছে, জমির মালিকদের নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। প্রায় ৯০ শতাংশ জমিমালিক টাকা নিয়েছেন। বাকি অংশের মালিকদের একটি সামান্য অংশ মামলা করেছেন। আবার কেউ কেউ শরিকি বিবাদের কারণে এখনও টাকা নেননি। কর্তাদের দাবি, এঁদের নিয়ে বিশেষ সমস্যা হবে না। সমস্যা হতে পারে জবরদখলকারীদের নিয়ে। তবে এ বার যদি তাঁরা স্বেচ্ছায় উঠতে না চান তা হলে জোর করে তুলে দেওয়া হবে। ভেঙে দেওয়া হবে বাড়ি বা দোকানঘর। সেই মতো প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। সেখানে জেলা প্রশাসনের তরফে সব সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের কৃষ্ণনগর প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিটের প্রকল্প অধিকর্তা সৌতম পাল বলেন, “প্রায় ৯৯ শতাংশ টাকা আমরা দিয়ে দিয়েছি। আমাদের দিক থেকে যা যা করার, আমরা করেছি। এ বার জমি ফাঁকা পেলেই কাজ শুরু করে দেওয়া হবে।” সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “জেলা প্রশাসন আমাদের সর্বতো ভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, এ বার আর কোনও সমস্যা থাকবে না।” জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯-১০ আর্থিক বর্ষে জমি রাস্তা সম্প্রসারণের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। ২০১০ সালে জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১২-১৩ সালে জমির মূল্য নির্ধারণ করে তা ঘোষণা করা হয়। জমিদাতারা আপত্তি জানালে একাধিক বার শুনানি হয়। সেই মতো জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কেউ-কেউ তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন।
আবার কোথাও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ জমির দাম অনেক বেশি নির্ধারণ করেছেন বলে দাবি তুলে আদালতে মামলা করা হয়। যেমন, তাতলা মৌজার জমির দাম নিয়ে আদালতে মামলা করেছেন জতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষই। সেই মামলার এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর আগে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমি ফাঁকা করতে না পারায় খরচ বৃদ্ধির কথা জানিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল এই অংশের রাস্তা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ‘মধুকন’। নানা টানাপড়েনের পরে ২০১৬ সালে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাদের তিনটি প্লান্টের প্রায় চার কোটি টাকার সম্পত্তি। ২০১৭ সালে এই অংশের রাস্তা সম্প্রসারণের দায়িত্ব নেয় রাজ্য সরকার। পূর্ত দফতর টেন্ডার ডেকে একটি সংস্থাকে দায়িত্বও দিয়েছে। কাজের প্রথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ জানান, ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর সড়কের দখলমুক্ত করার কাজ শুরু হবে।
জেলাশাসক বিভু গোয়েল বলেন, “এ বার জমি দখলমুক্ত করা হবেই। আমরা সব রকম প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy