সচেতনতা: নদী পাড়ের ওই কলোনিতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার পাঠ দিচ্ছেন কেন এন কলেজের পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র
জেলাশাসকের বাংলোর কিচেন গার্ডেনটা স্পষ্ট দেখা যায় কলোনি থেকে।
তার পর, চিনে ঘাসের কেয়ারি, বকুল-জামরুল-অর্জুনের সারি। আরও খানিক এগিয়ে গেলে বাংলোর ঢালু ছাদ, জেলার দন্ডমুণ্ডের কর্তার বাহারি বারান্দা। যেখান থেকে ঢিল ছুড়লে করোগেটেড শিট আর টালির সার দেওয়া গাঁধী কলোনির চালায় নিশ্চিৎ পতন, গাঁধী কলোনি।
মেঘ ঢাকা দুপুর, সরু ইট পাতা রাস্তায় সেখানেই দেখা তাঁর সঙ্গে, মাস ছয়েকের ছেলেটাকে স্পষ্ট বিরক্তিতে ডান কাঁধে ফেলে মহিলা বলছেন— ‘‘ছেলেমেয়েগুলো আর কয়েকটা মাস আগে এলে না ...।’’ হ্যাঁ, চাইতেন না আরও একটা সন্তান। মধ্য কুড়ির রূপা বিশ্বাসের গলায় চৈত্রের ঝাঁঝ— ‘‘ছেলে সামলাব না বাবুর বাড়ি কাজ, কে চাইত সন্তান? একটা সরকারি টেনিং (পড়ুন ট্রেনিং) থাকলে দোরে দোরে ঘুরতে হয়!’’
রূপার স্বামী তপন, বহরমপুর শহর জুড়ে মাথায় অব্যর্থ ব্যালেন্সের খেলা দেখিয়ে কার্বাইডের আলো বয়ে ফিরি করেন মশলা-মুড়ি। রূপা বলেন, ‘‘ওই তো জেলাশাসকের বাংলো, খবরটা একটু আগে দিতে পারল না!’’ তবে, সক্কলের তো আর রূপার দশা নয়, ভাগীরথীর পূর্বপাড় বরাবর রামেন্দ্রসুন্দ্রর সেতুতক— গাডির চালক, ঠেলা-ভ্যান-রিকশা ঠেলে রুজির সন্ধান করা মানুষ, রং মিস্ত্রি, গ্যারাজ কর্মী, ফিরিওয়ালা— সক্কলের ঠাঁই। নদী পাড়ের খাস জমিতে এক ফালি ঘুপচি-ঘিঞ্জি ঘর, পাঁচ ইঞ্চির ইটের দেওয়ালের উপর টালি, আর, শহরের নানা রোগের আঁতুরঘর। ক্রমে চকচকে হয়ে ওঠা বহরমপুর শহরের সেই কলোনি, আক্ষরিক অর্থেই প্রদীপের নীচে অন্ধকার।
‘দত্তক’ হিসাবে সেই আঁধারকেই বেছে নিয়েছে কৃষ্ণনাথ কলেজের ‘জাতীয় সেবা প্রকল্প’ (এনএসএস)। রুরাল ডেভলপমেন্ট অব সেল্ফ এমপ্লয়মেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় মহিলাদের স্বনিভর্র করা, পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে ছোট ব্যবসায় তাদের পাশে দাঁড়ানো— এমনই অজস্র বাড়ানো হাত নিয়ে কলেজ পড়ুয়ারা এখন দিন ফেরাচ্ছেন গাঁধী কলোনির। কলেজের এনএসএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাস্কর ভৌমিক জানান, ‘‘কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ওই সংস্থা মহিলাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আর সে দায়িত্ব পড়েছে আমাদের এনএসএস করা ছেলেমেয়েদের উপরে।’’ গত ফেব্রুয়ারি থেকে ছাত্রছাত্রীদের ন’টি দল কলোনির দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বোঝাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধি, নারীর ক্ষমতায়ন, কেরিয়ার কাউন্সেলিং, ডিজিট্যাল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা।
তাদের কথা হাঁ করে শুনে, মঞ্জু হালদার বলছেন, ‘‘কলেজের ছেলেমেয়েরা বাড়ি বয়ে বলে গিয়েছে সরকারি প্রকল্পের বিনা পয়সার ট্রেনিং-এর কথা। আমি একটা বিউটি পার্লার খুলব, ঋণও মিলবে।’’ স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন মঞ্জুরা।
ফুচকা বিক্রি করেন সুপদ দাস। বলছেন, ‘‘হাঁফিয়ে উঠছি দাদা। আর টানতে পারছি না সংসার।’’ তাঁর স্ত্রী আলপনা টানা কল থেকে জলের জেরিক্যান নিয়ে ফেরার পথে থমকে দাঁড়ান। একটা লম্বা হাসি খেলে যায় তাঁর মুখে— ‘‘জানেন ওঁরা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে। তা হলে একটু বাড়তি আয় হবে। দু’টো ছেলেকেই পড়াব তা হলে।’’
গাঁধী কলোনির আকাশ থেকে মেঘ কেটে যাচ্ছে যেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy