Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
‘দিদি এই হাল জানেন?’

সরকারি জুতো ফেটে ফুটিফাটা পা

কালো জুতোর মাথা গলে উঁকি মারছে বুড়ো আঙুল। গাছতলায় দাঁড়িয়ে ক্লাস সিক্স বলছে, ‘‘রোদের কী জ্বলন গো, মাটিতে পা ফেললেই পুড়ে খাক!’’ নারকেল দড়ি দিয়ে তাই পিছমোড়া চেটো, পাছে জুতোর সোল খুলে বেরিয়ে যায়!

অগত্যা: ছিঁড়ে গিয়েছে জুতো। এ ভাবেই স্কুলে আসে। করিমপুরের একটি স্কুলে। নিজস্ব চিত্র

অগত্যা: ছিঁড়ে গিয়েছে জুতো। এ ভাবেই স্কুলে আসে। করিমপুরের একটি স্কুলে। নিজস্ব চিত্র

সামসুদ্দিন বিশ্বাস ও সুজাউদ্দিন
কৃষ্ণনগর ও ডোমকল শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৫৯
Share: Save:

কালো জুতোর মাথা গলে উঁকি মারছে বুড়ো আঙুল।

গাছতলায় দাঁড়িয়ে ক্লাস সিক্স বলছে, ‘‘রোদের কী জ্বলন গো, মাটিতে পা ফেললেই পুড়ে খাক!’’

নারকেল দড়ি দিয়ে তাই পিছমোড়া চেটো, পাছে জুতোর সোল খুলে বেরিয়ে যায়!

বছর দুয়েক আগে, বীরভূম থেকে ফেরার পথে কাঁকসার কাছে উচ্ছ্বল এক ঝাঁক খুদে পড়ুয়াকে খোলা পায়ে রাস্তা পার হতে দেখে মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর। গাড়ি থেকেই ফোন গিয়েছিল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে— বাচ্চাদের পায়ে তুলে দিতে হবে জুতো। সে কাজে তড়িঘড়ি নেমে অধিকাংশ পড়ুয়ার পায়ে জুতো জুটেছিল বটে, তবে তার মান যে তেমন পোক্ত নয়, বছর ঘুরতেই বোঝা গিয়েছিল।

জুতো পায়ে অভ্যস্থ হওয়ার আগেই ফের তাই পুরনো অভ্যাসে ফিরে গিয়েছিল তারা। তবে, এই চৈত্র-ফাটা দাবদাহ ফের সেই জুতোর প্রসঙ্গটা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। নদিয়ার ভূতপাড়া থেকে ডোমকলের নিশ্চিন্দিপুর— ফের খোলা পায়ের হাট বসে গিয়েছে যেন।

সোমবার, খড়্গপুরে এক সরকারি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের শুনিয়েছেন, সেই জুতো-জামা-বইয়ের গল্প। ডোমকলের পঞ্চম শ্রেণির সাকিব আহমেদ গাছতলায় দাঁড়িয়ে বলছে, ‘‘দিদি আমাদের ছেঁড়া জুতোর কথা জানেন!’’

খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, প্রাক প্রাথমিক থেকে ষষ্ট শ্রেণি, জুতো পেলেও সে জুতোর হাল ফুটিফাটা মাঠের মতো। শুনেছেন সে কথা?

নদিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান রমাপ্রসাদ রায় বলছেন, “এ বছর এখনও তো জুতো আসেনি। তবে, গত বারের দেওয়া জুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে বলে কোনও অভিযোগ তো পাইনি।’’ আর, মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান দেবাশিস বৈশ্য জানিয়েছেন, পড়ুয়াদের জুতো ছিঁড়ে যাওয়ার কথা তাঁর কানে এসেছে। বলছেন, “নতুন জুতো করে দেওয়া হবে তা তো বলতে পারি না। নির্দেশ এলেই জুতো দেওয়া হবে।”

নদিয়ার কৃষ্ণনগর আদিবাসী প্রভাবিত যাত্রাপুর ভূতপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, পড়ুয়াদের অধিকাংশেরই খালি পা।

কী রে জুতো কোথায়? হাত ওঠে এক সঙ্গে, ‘‘ছিঁড়ে গেছে।’’ কেউ কেউ তপ্ত মাটিতে পা রাখতে না পেরে সস্তার চটি পায়েই এসেছে স্কুলে। দীপ দেবনাথ, টুম্পা মজুমদারেরা জানাচ্ছে, শতছিন্ন জুতো পরে তো আর স্কুলে আসা যায় না, তাই হাওয়াই চটি পরেই এসেছে। আর, তৃতীয় শ্রেণির সুশীলা সর্দার বলছে, “স্কুল থেকে যে জুতো দিয়েছিল তা কবেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে জুতো কিনে দিল না বাবা। তাই খালি পায়েই এসেছি।’’

কৃষ্ণনগরের বেড়াবেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশ কিছু পড়ুয়া স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, তাদের জুতো ছিঁড়েছে পুজোর আগেই। স্কুলকে জানিয়েও সাড়া মেলেনি। ওই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী পল্লবী মিস্ত্রি বলছে, ‘‘স্কুল থেকে দেওয়া জুতোটা পায়েই ঢুকত না। দু-তিন দিন পরার পরেই ছিঁড়ে গেল!’’

ছবিটা একই মুর্শিদাবাদের ছোট-মেজ স্কুলগুলিতেও। ডোমকলের বিলাসপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয় কিংবা নিশ্চিন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাঝে খাল বিল মাঠ— প্রায় পনেরো কিলোমিটারের দূরত্ব। তবে, সেই দূরত্ব মুছে তাদের এক করে দিয়েছে ‘ছেঁড়া জুতো’র গল্প। বিলাসপুরের চতুর্থ শ্রেণি হাসিবুল মণ্ডল বলছে, ‘‘আগে জুতো পরিনি, কিন্তু পরতে পরতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, কী আরাম। আমরা আর জুতো পাব না?’’

অন্য বিষয়গুলি:

Students Summer Shoes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy