পিলারের ও পাড়ে, ঢালু জমিতে শেয়ালের অজস্র গর্ত। টাল সামলে নেমে গেলে, ইস্রাইলের এক ফালি আবাদ। সাকুল্য যার সাড়ে তিন কাঠা তার বাপের, বাকিটা ওসমান আলির কাছে ভাগে নেওয়া। জমির আলে কাঠির উপরে সুপারম্যান আঁকা ছেঁড়া একখানি গেঞ্জি ঝুলিয়ে দিয়েছে ইস্রাইল, কাকতাড়ুয়ার মাঠ পাহারা। স্বদেশের জমি জিরেতের এখানেই ইতি। তার পর পাক্কা তিন খানা আলের পর, মেঘের ছায়ায় সবুজ হয়ে আছে, জেলা কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
জমি যেখানে শেষ ভরা নদীর শুরু সেখানে। ও পাড়ের মানুষ আদর করে ডাকে, মেন পদ্মা। নদী খাত বদলে সরু হয়ে এসেছে যেখানে, সম্বৎসর সেখানে একটা ছই নৌকা বাঁধা। বর্ষার খান চারেক মাসের গহীন পানিটুকু বাদ দিলে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আতারপাড়ার পায়ে হেঁটেই যোগসূত্র। তার কোনও বদল হয়নি।
তাদের চর পরাশপুরের সঙ্গে নদী টপকানো জলঙ্গির যেমন। আড়েবহরে হুহু করে বেড়ে ওঠা জলঙ্গির গঞ্জে হ্যাজাক মুছে এখন এলইডি আলোয় পা পিছলে যায়। রাতের পদ্মায় সে আলো শহুরে জ্যোৎস্নার মতো চিকচিক করে। বাঁধানো রাস্তা, মোবাইলের দোকান, রোল-চাউমিনের স্টল, চৌমাথার দোকানে টানটান ঝোলে মেয়েদের স্কিনটাইট জিন্স আর গেঞ্জি।
চরের সঙ্গে ভূখণ্ডের এই দেশজ বিভাজনটুকু সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে ইস্রাইল। ও পাড় এ পাড়, চর আর ভূখণ্ডের মাঝে সাঁকোটুকু আর বাঁধা গেল না! পুরনো মনখারাপের মতো চর পড়ে থাকে তার আদিম চেহারা নিয়েই, পরাশপুরের অবশ্য তাতে কোনও হেলদোল নেই। সেই শরবন আর হুহু মাঠ নিয়ে এখনও অস্পর্শ এক পল্লিকথা। গ্রামীণ যোজনায় সার দিয়ে খান পঞ্চাশ দেড় কামরার ঘর উঠেছিল বটে, তবে সে ঘরের মালিকানা বাঁটোয়ারার আগেই দুর্যোগের হাওয়ায় বাড়ির চালা উড়িয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে পদ্মা। নতুন বলতে একখানা দোতলা ফ্লাড শেল্টার। একতলা জুড়ে গরু-ছাগলের নাদা আর দোতলাটা সারা বছর দখল নিয়ে থাকে জলপাই উর্দি।
বাগমারা স্কুলে দশ ক্লাসের টেস্টে থমকে গিয়ে যখন পড়াশোনার স্বপ্নে পাকাপাকি দাঁড়ি পড়ে গেল, আব্বার সঙ্গে শীতের চাষে সে বারই প্রথম আবাদি জমিতে পা দিয়েছিল ইস্রাইল। তার পর থেকে গঞ্জের দিকে পা বাড়োনর তেমন আর প্রয়োজন পড়ে না তার। এমনই নিরন্তর সেই চর-যাপনের মাঝে গ্যালো বর্ষায় মাঠের কাদায় নতুন করে আতারপাড়ার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল ইস্রাইল।
ঝাঁপতালে বৃষ্টি নামতেই ও পাড়ের গজশিমুলের ছায়া থেকে ডাক এসেছিল, ‘আরে বৃষ্টিতে ভিজতেস ক্যান, এই হানে আইস দু’দণ্ড খাড়াইয়া জ়াও।’ আল পথের সীমানা ভেঙেই ইস্রাইল এক ছুটে গিয়ে উঠেছিল ও দেশের ঝাঁকড়া গাছটার নীচে। খান তিনেক বৃষ্টিস্নাত আবাদি মানুষের মাঝেই চোখ পড়েছিল, হাত কয়েক দূরে আধ-ভেজা শাড়ি, বৃষ্টি-বিরক্ত রুখু মুখ, দাঁড়িয়ে আছে সে। প্লাস্টিকের ব্যাগে এক বোতল জল আর স্টিলের একটা কৌটো বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা। জড়সড় হয়ে এ সবই দেখার ফাঁকে বৃষ্টি ভেজা মানুষগুলোর কেউ যেন গুনগুন করে, ‘ও হুমাইদা ঘর জ়াবি ক্যামনে রে!’ সেই দুপুরে নামটা বঁড়শির মতো গেঁথে গিয়েছিল ইস্রাইলের।
সেই থেকে মেঠো বকের মতো তার চোখ তাকে খোঁজে, আলে, নদীর চড়ায়, গ্রামের সরু বেলে রাস্তায়, দেখাও পেয়ে যায় কখনও। আব্বার জন্য এক থালা ভাত-শাক আর সরলপুঁটির ঝোল নিয়ে আলের গায়ে বসে কখনও বা মশারির জালে মাঠে মাঠে কুচো মাছের খোঁজ করছে— মনে মনে ভাবে, ভিন দেশি সেই কন্যাকে চুরি করে কত বার যে দেখেছে সে। শুধু কথা হয় না।
আসসা হুমাইদা, তুমাগো ঘরের পিসনে জামরুল গাসখান আসে এহনও... রাতের পদ্মায় কহনও পারপার করস...তুমা গো বিজিবি আমাগো বিএসএফের ন্যায় বড় ঠেঁটা, লয়?--নিজের মনেই হুমাইদার সঙ্গে তার নিরন্তর আটপৌরে গল্পের বুজকুড়ি। সেই সব দাঁতে ঘাস কাটা নদী চরের কল্প কাহিনিতে, ‘ঘরে ভাইবোন কয় জন, চরের বসত কত দিনের, আব্বার কয় বিঘা জ়মি’, এমন গার্হস্থ্য প্রশ্নের নাও ভিড়তেই পারে না ইস্রাইলের জলা জমিতে। ভিড়বে কি করে, ইস্রাইল বড় অন্যরকম। সে বার যখন ক্লাশ নাইনের পরীক্ষায় রচনা এল, আমার গ্রাম, ইস্রাইল লিখেছিল— ‘আমার গ্রামের কোনও ঠিকানা নেই। শুধু চর পরাশপুর, আজ আছে কাল নেই।’ এক মুখ পান নিয়ে চশমাটা নাকের মাঝামাঝি নামিয়ে বিনয় স্যরের কথাটা এখনও মনে আছে ইস্রাইলের, ‘বাব্বা, তুই দেখত্যাসি দার্শনিক অইবি!’ বালকবেলার সেই ক্লাশে বিনয়বাবুর কথাটা বাহবা না ঠেস, আজও বুঝতে পারেনি ইস্রাইল। তবে অনন্ত এই চরের সত্যিই যে কোনও ঠিকানা হয় না, চরের কাদায় পা গেঁথে যাওয়া ইস্রাইল আজকাল তা টের পায়। এই আছে এই নেই। ভোরের পদ্মা, বিকেলে চেহারা বদলে হয়ত নিয়ে গেল তারে! যতোই এ-ওর গায়ে গায়ে লেগে থাকুক, পরাশপুর-টলটলি-আতারপাড়া-বাংলাবাজার-হুমাইদা-এক্রাম আলি... কেউ-ই বুঝি স্থায়ী নয়, ঢিপির উপরে বসে বসে আমগ্ন ইস্রাইল ভাবে, সত্যিই তো আজ আছে কাল নেই!
এই অনাদি অনিশ্চয়তার মাঝে সে দিন মেঘ দুপুরে ভুউশ করে ভেসে উঠল হুমাইদা। আলের পাশে কোঁচ বকের মতো ঝুঁকে ঝুঁকে গুগলির খোঁজ করছে, সেই সবুজ পাড় কালো শাড়ি, আরও খানিক খসটে হয়ে গিয়েছে এই ক’দিনে।
মাঠ থেকে আলের উপরে উঠে দাঁড়ায় ইস্রাইল। সাহস করে আরও একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আল ধরে এগিয়ে যায় কিছু, এই বার ঠিক দেখতে পাবে তাকে, মুখ তুললেই....
—হুমাইদা
টান টান দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়ে। ইস্রাইল অবাক হয়ে দেখে, সেই শাড়ি, তেমনই রুখু মুখ, কপালে ভাঁজ...কিন্তু হুমাইদা নয়।
—হুমাইদা’রে সিনলেন ক্যামনে, আপনার ঘর তো ইন্ডিয়ার গিরামে?
ইস্রাইলের মেঘে ঢাকা মুখের ওপরে বৃষ্টির ছাঁটের মতো ছুটে আসে কথাটা...
—আতারপাড়ার হুমাইদার কথা কইত্যাসেন তো...জ্বর অইসিল, বাংলাবাজারের আসপাতালে লয়া জ়াইবার আগেই ইন্তেকাল অইল ... গত অপতায়....
অস্পষ্ট হয়ে আসে কথাগুলো... আবছা হয়ে আসে দুপুর। ইস্রাইলের কানের কাছে যেন অজস্র পাখির কিচিরমিচির...আলের কিনারে ঝুপ করে বসে পড়ে সে।
বৃষ্টি শুরু হল, আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। চরের দিগন্ত ছুঁয়ে এ পাড়ের গাঙ শালিখের ঝাঁক উড়ে যায় ও পাড়ে, সন্ধে নামে চুপিসারে, ও পাড়ের মাগরিবের আজানের সুর সহজ শ্বাসবায়ুর মতো ভেসে আসে এ পাড়ে। শুধু ইস্রাইল উড়তে পারে না। চরের অনুশাসনে অদৃশ্য কাঁটাতারে ডানা গাঁথা প্রজাপতির মতো নিশ্চুপে ছটফট করে।
শিশিরের মতো অন্ধকার ঝরে পড়ছে, ঝিঁঝি ডাকছে খুব। আলের সীমানা লঙ্ঘন করতে না পারা দীঘল এক ফড়িঙের মতো আলের ঘন শর-ঝোপের পাশে চুপ করে বসে থাকে ইস্রাইল, ভাবে--পদ্মা ঘেরা এই এক ফালি জমিতেই দুই খানি দেশ। তাদের কথা আছে বার্তা নেই। গন্ধ আছে স্পর্শ নেই। এই আছে এই নেই, তবু ...জ়াওয়ার আগে এক বার বলতি অয় হুমাইদা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy