রানাঘাটে কংগ্রেসের প্রচারে প্রার্থীর সঙ্গে রয়েছে শঙ্কর সিংহের ছবি।
তিনি দলে আর কত দিন— তা নিয়ে জল্পনা দীর্ঘ দিনের। অথচ তাঁকে সামনে রেখেই পুর-নির্বাচনের ময়দানে নেমেছে রানাঘাটের কংগ্রেস কর্মীরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে ব্রাত্য রেখে শঙ্কর সিংহের ছবি হাতে প্রচার চালাচ্ছেন স্থানীয় কংগ্রেস কর্মীরা। কেন? রানাঘাটের কংগ্রেস প্রার্থীদের স্পষ্ট জবাব, ‘‘আমরা তো বটেই শহরের সাধারণ মানুষও শঙ্করদার উপরেই ভরসা রাখেন। তাই আমরা তাঁকে প্রচারের মুখ করেছি।’’
তার নিট ফল, শহরের যে ছ’টি ওয়ার্ডে কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত প্রার্থী দিতে পেরেছে তার বেশির ভাগ এলাকাতেই ব্যানার, ফ্লেক্স, পোস্টারে শঙ্কর সিংহের ছবি। গোটা শহরে প্রদেশ সভাপতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া ভার। একই অবস্থা অধীরবাবুর অনুগামী বলে পরিচিত জেলা সভাপতি অসীম সাহারও। কেন এমনটা হল?
শহরের প্রার্থীরা এক বাক্যে বলছেন, ‘‘শঙ্করদার সঙ্গে দীর্ঘ দিন লড়াই করে আসছি, তাঁকে বাদ দিয়ে আমরা এখনই কিছু ভাবতে পারি না।’’ একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, ‘‘অন্য কেউ তো যোগাযোগই করছেন না!’’ শঙ্করও অনুগামীদের নিরাশ করেননি। ফ্লেক্স, ব্যানার তৈরি করে দেওয়া থেকে নির্বাচনী প্রচার— সব রকম ভাবে অনুগামীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন জেলা কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। শেষ মুহুর্তে তিনি প্রচারে যেতে পারেন বলেও দাবি অনুগামীদের। রানাঘাটের কংগ্রেস প্রার্থীদের অনেকে কবুলও করছেন, ‘‘শঙ্করদা বলেছেন বলেই তাঁরা প্রার্থী হয়েছেন।’’
এক সময় রানাঘাট শঙ্কর সিংহের গড় বলে পরিচিত ছিল। গত পুর নির্বাচনের আগে তাঁর অনুগত পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়-সহ বহু কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় পরও তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস তিনটি আসনে জয় পেয়েছিল। অনুগামীদের দাবি, শঙ্করদা চাইলে এখনও প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিয়ে জোর লড়াই দিতে পারেন। এক নেতার কথায়, ‘‘দাদা তা কুপার্স ক্যাম্প পুরসভা নির্বাচনেই দেখিয়ে দিয়েছেন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও ২০১২ সালে এই পুরভোটে শঙ্করদা ১২টির মধ্যে ১১টিতেই কংগ্রেস প্রার্থীদের জিতিয়ে এনেছিলেন। তৃণমূল জুটেছিল মাত্র একটি আসন।’’
কী বলছেন শঙ্কর? তাঁর কথায়, ‘‘এখনই দলবদলের কথা ভাবছি না। তবে বর্তমান প্রদেশ সভাপতির নেতৃত্বে রাজনীতি করার মতো মানসিক অবস্থায় নেই।’’ কেন? এর উত্তরে অধীরের বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ দেগেছেন তিনি। শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘৪০ বছর ধরে বহু নেতার সঙ্গে রাজনীতি করেছি। কিন্তু বর্তমান সভাপতির কাছ থেকে যে ভাবে অপমানিত হয়েছি, তেমনটা আগে কখনও হইনি।’’ শঙ্করের দাবি, ‘‘দলের কর্মীরাই সব চাইতে অপমানিত। অসম্মানিত নেতারাও। এত দিন যাঁরা দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তাঁদের ন্যূনতম সম্মান জানানোর মানসিকতা তাঁর নেই। সে জন্যই কংগ্রেসের এই পরিণতি— ভোট কমতে কমতে ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৩০ বছরে কংগ্রেসের এই করুণ অবস্থা হয়নি।’’ সে জন্যই কী রানাঘাটের কংগ্রেসের কর্মীরা আপনার উপরে ভরসা রাখছেন? শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরে সকলের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা করছি। সেই কারণেই ওদের আস্থা এখনও রয়েছে।’’
শঙ্করের কথার সমর্থন মিলেছে প্রার্থীদের বক্তব্যেও। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী তথা পাঁচ বারের কাউন্সিলর কজ্জ্বোল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা শঙ্কর সিংহ ছাড়া কাউকে চিনি না। খুব কাছ থেকে দীর্ঘ দিন তাঁকে লড়াই করতে দেখেছি। ওঁকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করার কথা ভাবতে পারি না। এখনও অনেকের চেয়ে শঙ্কর সিংহ মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।’ ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শঙ্কর অধিকারী বলেন, ‘‘শঙ্করদা বলেছেন বলেই ভোটে দাঁড়িয়েছি। সব রকম ভাবে তিনি পাশে আছেন। ধারে কাছে তো আর কাউকে দেখছি না।’’
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘রানাঘাটে যাঁরা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন ঠিক কী হচ্ছে। শুধু আমাকে চিনতে হবে এমনটা আমি বলছি না। শঙ্কর সিংহ দীর্ঘ দিন ধরে রানাঘাটে রাজনীতি করছেন। সেখানকার মানুষ তাঁকে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক।’’ শঙ্করের তোপ প্রসঙ্গে অধীর বলেন, ‘‘শঙ্করবাবু আমার ভালই চান। কেন তাঁকে অপমান করতে যাব?’’ পুর-প্রচারে প্রদেশ সভাপতিকে পুরোপুরি ব্রাত্য করে দেওয়া কেন? তা ছাড়া শঙ্কর তো তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়েই আছেন? প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতির জবাব, ‘‘একটাই কারণ। রানাঘাটের মানুয অন্য যে কারোর থেকে শঙ্কর সিংহকেই বেশি চায়। তিনি থাকলেন কি অন্য কোনও দলে গেলেন সেটা বড় নয়।’’
বিষয়টির এত সহজ ব্যাখ্যায় রাজি নয় তৃণমূল। এলাকার বিধায়ক তথা রানাঘাটের বিদায়ী পুরপ্রধান তৃণমূলের পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় এক সময় শঙ্করের ঘনিষ্ট বলেই পরিচিত ছিলেন। শোনা যায়, যে সব জেলা নেতৃত্ব শঙ্করের তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তাঁদের মধ্যে তিনিও রয়েছেন। পার্থবাবু বলেন, ‘‘আসলে একটা খেলা চলছে। তবে সুবিধে হবে না। কারণ মানুষ বুঝে গিয়েছেন উনি পাঁচিলের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।’’
রাজ্য রাজনীতিতে এক সময় শঙ্কর-অধীরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অনেকেই জানেন। আজ তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ ফাটল। কংগ্রেসের কিছু কর্মীর মত, লোকসভা ভোটে কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে প্রার্থী নির্বাচনকে ঘিরে দু’জনের মধ্যেকার তিক্ততা চরমে পৌঁছয়। যছা তা তলানি। তৃণমূলে যোগ দেওয়া নিয়ে হাজার বিতর্কের মধ্যে রানাঘাটের কংগ্রেস কর্মীরা যখন তাঁকে সামনে রেখেই লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়েছে, তখন সেই শহর ব্রাত্য করে রেখেছে অধীর চৌধুরীকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy