Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

মাঘ কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছে বিয়ের পদ্যও

লাল কাপড়ের ঝালর দেওয়া শামিয়ানার নীচে গোবর নিকানো তকতকে উঠোন। তার উপর বিছানো শতরঞ্চি। সারি দিয়ে বসে নিমন্ত্রিতের দল। শেষ পাতের দই ও চাটনিতে মাখামাখি হাত নিয়ে বের হচ্ছেন তাঁরা। বিগলিত গৃহকর্তা জিজ্ঞাসা করছেন— ‘খাওয়া-দাওয়ায় কোনও ত্রুটি হয়নি তো?’’

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫২
Share: Save:

লাল কাপড়ের ঝালর দেওয়া শামিয়ানার নীচে গোবর নিকানো তকতকে উঠোন। তার উপর বিছানো শতরঞ্চি। সারি দিয়ে বসে নিমন্ত্রিতের দল। শেষ পাতের দই ও চাটনিতে মাখামাখি হাত নিয়ে বের হচ্ছেন তাঁরা। বিগলিত গৃহকর্তা জিজ্ঞাসা করছেন— ‘খাওয়া-দাওয়ায় কোনও ত্রুটি হয়নি তো?’’

মুর্শিদাবাদ জেলার সাবেক বিয়ে বাড়ির ওই দৃশ্য এখন বিস্মৃত ছবি! তেমনি ধূসর হয়ে গিয়েছে বিয়ে সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষঙ্গ। তার অন্যতম বিয়ের পদ্য। বিয়ের পদ্য বিয়ের অঙ্গ হিসেবে দেখা হত। বিয়ের পদ্য না হলে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ যেমন হতাশ হতেন, তেমনি পড়শিদের মধ্যে তা নিয়ে কম সমালোচনা শুনতে হতো না।

কেমন ছিল সেই পদ্য?

‘‘আয় চাঁদ আয় না/পরছে কাকি গয়না/আয়রে আয় বিয়ে/ছাদতলাতলা দিয়ে/ফলার খেতে সালার/চলল কাকু এবার/সঙ্গে যাবে কে/ ভাইপো-ভাইজিরা ছিল তারাই সেজেছে।’’ ‘কাকু’র বিয়েতে কাকুকে উদ্দেশ্য করে ভাইপো-ভাইজিদের কথা লেখা হয়েছে পদ্যটিতে। ওই পদ্যের পাতায় বড় বড় হরফে ‘শুভ পরিণয় সংবাদ’ শিরোনামে পাত্র ও পাত্রীর নাম বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকত। ‘শুভ সমাচার পত্রিকা’—কোনও কোনও বিয়ের পদ্যের শিরোনাম হত। পদ্যের পাতার নিচের অংশে মজা করে লেখা হত—‘‘নববর্ষের নতুন ছবি (মাত্র দু’দিনের জন্য)। ছবির নাম—মীনাকুমারী (যেহেতু পাত্রী নাম মিনা)।’’

দুই দাদার বিয়ে এক সঙ্গে হওয়ায় নতুন দুই বৌদির কাছে দেওরদের আবদার—‘‘এই দুটি দিন মাত্রা মোদের/ মিটিবে সকল দাবি/তাহার অধিক পাওনা পাবো/একটি জোড়া ভাবি।’’ পাল্টা দেওরকে পদ্যে বলা বৌদিদের কথা—‘‘বৈশাখের এ রোদ্দুরেতে পালা করলাম ভঙ্গ/ভুলো না ভাই মোদের যেন মেয়ে প্রিয়ার সঙ্গ/ রঙ্গরসের চচ্চড়িতে খুব হয়েছে খাটনি/অবশেষে দিলুম পাতে কচি আমের চাটনি।’’

বিয়ের ওই পদ্যে হয়তো সেই অর্থে কোনও পদ্যগুণ নেই। এক সময়ে ওই সব রচনায় পদ্য হিসেবে পরিচিতি ছিল। এখন যেমন বিয়ে বাড়িতে খাবারের আগে হাতে মেনু কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়, বছর ২০/২৫ আগে তেমনই বর অথবা কনেযাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত রঙিন লিফলেটের মতো তিন-চারপাতার ছাপানো কাগজ। সেই কাগজেই ছাপা ‘অন্ত্যমিল’ ছন্দে রচিতকে বলা হত পদ্য।

প্রয়াত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ তাঁর ছোট ভাইদের বিয়েতে পদ্য লিখেছেন। ওই পরিবারের সদস্য সৈয়দ খালেদ নৌমান জানান, দাদা পদ্য লেখা থেকে নিজে হাতে প্রুফ দেখতেন, যাতে বানান ভুল না থাকে। তখন পরিবারের সদস্য সকলের নাম উল্লেখ করে পদ্য লেখা হত। পাত্র ও পাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের সেতু তৈরির প্রথম পাঠ ওই পদ্য। বিয়ের দিন ওই পদ্য নতুন বর ও নতুন বৌ হাতে পেয়ে পরিবারের সদস্যদের নামের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটত, তেমনি সম্পর্ক অনেক সহজ হয়ে যেত বিয়ের দিনই।

এমনকি বিয়ের পদ্যে শ্বশুর-শাশুড়ি পদ্যের মাধ্যে দিয়ে নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করতেন—‘‘সংসার সমুদ্র বড় ঝটিকাচঞ্চল/ নিষ্কম্প সুস্থির লক্ষ্য সংহত নির্ভীক/ থেকো বাছা দুটি প্রাণ একাত্ম অটল/ মঙ্গলময় বিধি আশীর্বাদ দিক।’’ ওই পদ্যই আজ হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না ওই পদ্যের কথা। আর বিয়ের আসরে ওইসব পদ্যেরও দেখা মেলে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Marriage Berhampu Custom
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE