প্রতীকী চিত্র।
দিনটা স্পষ্ট মনে পড়ে মাজেদা বিবির। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল ক’দিন ধরে। বাঁধের কানায় কানায় জল। তা-ই দেখে প্রমাদ গুনেছিলেন গ্রামের লোকজন। বাঁধ যদি ভাঙে তো ভিটেমাটি হারাতে হবে সবাইকে। তাই বৃষ্টি উপেক্ষা করে কালীগঞ্জের ঘাসুরিয়াডাঙার গ্রামের বাসিন্দারা বেরিয়ে পড়েছিলেন ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে। বালির বস্তা, বাঁশ পুঁতে চলছিল বাঁধ শক্তপোক্ত করার কাজ।
তার পর রাত জাগার পালা। বাড়ির ছোটদের ঘুম পাড়িয়ে বড়রা তাকিয়ে ছিলেন বাঁধের দিকে। অন্ধকারে যদিও কিছু ঠাওর হয় না, শুধু দুরুদুরু বুকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকা। আর মনে মনে প্রার্থনা, এ বারের মতো বাঁধটা যেন টিকে যায়। বাঁধ টেকেনি।
ভোর হওয়ার আগেই হইচই পড়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি, নদীর গর্জন উপচে ছড়িয়ে পড়েছিল হাহাকার, কান্নার শব্দ। তার পর সকাল যত হয়েছে নিঃস্ব হতে হয়েছে অনেককে।
মাজেদা জানান, বাড়ির সামনে একটা পাকুড় গাছ ছিল। সকাল ৬টা-৭টা নাগাদ নদীতে তলিয়ে গেল সেটি। শিকড় উপড়ে বাঁধে গর্ত হতে সেখান গিয়ে হু-হু করে জলে ঢুকে পড়ে। তার পর চোখের সামনে তলিয়ে গেল দু’কুঠুরির মাটির বাড়িটা। সেই সঙ্গে বাসনপত্র, খাট-আলমারি, উঠোন, সাধের সংসার। চিরকালের মতো।
কথাগুলো বলে থামলেন মাজেদা বিবি। চোখের কোণে তখন এক কুচি জল। আঁচল দিয়ে তা মুছে বললেন, ‘‘তার পর আর কী। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মেজো মেয়ে বাড়িতে এসেছিল। বাড়ি তো গেল। এখন মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাই সেই চিন্তায় পড়লাম। পরে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল।’’
মাজেদা জানান, প্রথম তিন দিন খাবার বলতে সে ভাবে কিছু জোটেনি। পরে শুধু আদা সেদ্ধ চালই খেতে হয়েছে। ইতিমধ্যে মেজো মেয়ের সাজিলার প্রসব যন্ত্রণা ওঠে। গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। গ্রামের মেয়েদের সাহায্যে সেই প্রতিবেশীর বাড়িতেই সন্তান প্রসব হয়। গ্রামের সকলে মিলে সদ্যোজাতের নাম রাখেন ‘ভাসা’। ভেসে যাওয়ার কালে জন্ম যে!
দিন পনেরো পরে জল নামতে ফের বাড়ি গড়ে তোলার কাজে হাত লাগান। অশীতিপর মাজেদা বলেন, ‘‘কিন্তু সেই বাড়িটার কথা আজও মনে পড়ে। বর্ষা এলে সেই দিনগুলোর কথা মনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে ওঠে।’’ একটু থেমে তিনি বলেন, ‘‘শুধু কী বাড়ি ভাঙে, মনও তো ভাঙে।’’
ভাঙনে ভিটেমাটি খুইয়েছিলেন ঘাসুরিয়াডাঙারই বাসিন্দা দোয়া বক্স। ভাঙনের কথায় আদ্র হয়ে আসে তাঁর মনও। জানান, বাঁধ ভাঙতে জলের তোড়ে পলকে ভেসে গিয়েছিল মাটির ঘর। তিনি বলেন, ‘‘ওই তোড়ের মুখে কী-ই বা করতে পারতাম। চোখের সামনে দরকারি নথিপত্র সব ভেসে গেল। বাড়ির গরু ছাগলগুলোও।’’ স্ত্রী, ছোট ছোট দুই দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয়েছিল দোয়া বক্স। চারদিকে জল। আকাশও যেন ভেঙে পড়েছে। চার দিক ভিজে। রান্না করবেন কোথায়। জ্বালানিও বা কই। তাই প্রথম তিন দিন খাবার সে ভাবে জোটেনি। কাঁচা চাল চিবিয়ে খেতে হয়েছিল। পরে প্রশাসন চিঁড়ে-মুড়ি দেয়।
তাঁর কথায়, ‘‘বাঁধ আগের থেকে অনেক উঁচু, শক্তপোক্ত। তাই ভাবনা অনেক কমেছে। কিন্তু আজও বর্ষায় নদীর জল বাড়লে মনে দুশ্চিন্তার স্রোত বয়ে যায় বইকি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy