Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Narayan Debnath

Narayan Debnath: শৈশব গড়ে দিয়েছে প্রয়াত শিল্পীর কলম-রং

নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ছোটবেলা হারিয়ে ফেলে মঙ্গলবার বিষণ্ণ হয়ে রইল করিমপুর থেকে কল্যাণী, কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা।

n ২০১২ সালে কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনে নারায়ণ দেবনাথ, ছবি আঁকায় মগ্ন।

n ২০১২ সালে কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনে নারায়ণ দেবনাথ, ছবি আঁকায় মগ্ন। ফাইল চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৩০
Share: Save:

মনখারাপের মঙ্গলবার! অন্যায়কে স্রেফ ‘ফুঃ’ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া বাঁটুলদার কাজ ফুরোলো। নন্টে-ফন্টে আর কেল্টুদার বোর্ডিং স্কুল বন্ধ হল। হাঁদা-ভোঁদা নতুন কোনও দুষ্টুমিতে আর নাজেহাল করবে না পিসেমশাইকে। ছোটবেলার সব বন্ধুরা একসঙ্গে চলে গেল। নারায়ণ দেবনাথের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ছোটবেলা হারিয়ে ফেলে মঙ্গলবার বিষণ্ণ হয়ে রইল করিমপুর থেকে কল্যাণী, কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা। রং আর রেখার মানুষেরা দিনভর স্মৃতির ছবি আঁকলেন মনখারাপের তুলিতে।

“আমাদের কাছে নারায়ণ দেবনাথ অন্নপ্রাশনের শিল্পী।”— মন্তব্য বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের।

তিনি বলেন, “জ্ঞান হওয়াতক আনন্দমেলা, শুকতারার হাত ধরে হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে এবং বিশেষ করে বাঁটুলদা আমাদের শৈশব গড়ে দিয়েছিল।” যার টান বড় হয়েও অধিকাংশ বাঙালি এড়াতে পারেন না। তাই বুকস্টলে গিয়ে শুকতারা হাতে পড়লে অনিবার্য ভাবে পাতা উল্টে বাঁটুলের খোঁজে যেতেই হয় সব বয়সের পাঠককে। কৃষ্ণজিৎ মনে করেন, “নারায়ণ দেবনাথের লেখার সব চেয়ে বড় প্রসাদগুণ হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টেদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক শিশুসুলভ দুষ্টুমির প্রবণতা। শেষ পর্যন্ত অন্যায়কারী শাস্তি পেত। অবশ্য খুব নিষ্ঠুর কোনও শাস্তি নয়। বরং কিছুটা মজাদার সেই শাস্তির মধ্যে দিয়ে শিশুদের মনে একটা ধারণা গড়ে উঠত যে, অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয়।”

বিশাল ছাতি, খালি পা, হাফপ্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জির বাঁটুল সব সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো থেকে সব কিছু ভীষণ ভাবে বাঙালি ঘরানার। চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজের কাজে নারায়ণ দেবনাথের প্রভাব অস্বীকার করতে পারেন না তিনি। কৃষ্ণজিৎ বলেন, “ওঁর রেখার ডৌল এত পরিছন্ন যে, চমৎকার একটা লাবণ্য তৈরি হত চরিত্রগুলোর মধ্যে। কোথাও যেন মনে হয় আমার রেখায় সেই প্রভাব রয়ে গিয়েছে।”

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এবং কলা সমালোচক সুশোভন অধিকারীর মতে, “নারায়ণ দেবনাথের আঁকার মধ্যে এমন একটা নাটকীয়তা, চলমান মুহূর্তের ছোঁয়া পেতাম, যেটা আর কারওর বেলায় সে ভাবে মনে দাগ কাটেনি। যেন ক্যামেরা থেকে নেওয়া একটা মুহূর্তের শট। যেমন তার মুখের ভঙ্গি তেমন এক্সপ্রেশন, জামাকাপড়ের ভাঁজ সব মিলিয়ে নারায়ণ দেবনাথের ছবির মধ্যে সচল, প্রাণবন্ত জীবনের এক চেহারা ফুটে ওঠে। এখনও তেমনই মনে হয়।”

নিজের ছোটবেলায় পড়া হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভয়ের মুখোশ’-এর ইলাস্ট্রেশন এখনও চোখে ভাসে সুশোভন বাবুর। “নীচে থেকে আলো পড়ে এক ভয়ার্ত মুখ। তখন আমাদের ছোটবেলা। মনের উপর অসম্ভব ছাপ ফেলেছিল। ফোটোগ্রাফের বাইরেও শুধুমাত্র সাদা-কালো দিয়ে যে আলোছায়ায় ওই রকম দৃঢ়তা আনা যায়, সেটা নারায়ণ দেবনাথ দেখিয়ে দিয়েছেন। শারীরিক গঠনে তাঁর তুলনা ছিল না।’’

তাঁর মতে, ‘‘আমার কাছে ছেলেবেলায় শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন তিনি। সেই সময়ে দু’জন মানুষের কথা মনে পড়ে উনি এবং প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আর পরবর্তী কালে পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী। ছবিতে প্রাণের স্পর্শ কী করে আনতে হয়, আমার কাছে সে বিষয়ে নারায়ণ দেবনাথ সেরা।”

কার্টুনিস্ট ও ইলাস্ট্রেটর অভিজিৎ সেনগুপ্তের কথায়, “নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা-ভোদা, নন্টে-ফন্টের মজা ছাড়াও সেই ছবিগুলোর মুখের কমিক অভিব্যক্তি আমায় ভীষণ ভাবে টানত। সিরিয়াস গোয়েন্দা গল্পের ইলাস্ট্রেশন থেকে কত নকল করেছি। ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ তৈরি হওয়ার পিছনে নারায়ণ দেবনাথের ভুমিকা অনেক বেশি থেকেছে আমার মতো অনেকের কাছে।’’ তিনি আরও জানান, আর্ট কলেজের দিনগুলোতেও ছাত্রদের মধ্যে তাঁর ভুমিকা নিয়ে চর্চা লক্ষ্য করেছিলেন।

কল্যাণীর তরুণ শিল্পী অরুণাভ দাস কৌতুক চিত্র আঁকার ক্ষেত্রে নারায়ণ দেবনাথকে গুরুর আসনে বসিয়েছেন। তাঁর কথায়, “নারায়ণ দেবনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় যখন আমি ক্লাস থ্রি। দাদুর কাছে পাওয়া জীবনের প্রথম পূজাবার্ষিকী শুকতারায় আলাপ হয়েছিল হাঁদা-ভোঁদার সঙ্গে। তার পর থেকে এদের সঙ্গ ছাড়িনি।’’

তিনি বলেন, ‘‘পরে আমি যখন নিজে আঁকার জগতে পা রাখলাম তখন নারায়ণ দেবনাথের প্রভাব অস্বীকার করতে পারিনি। বিশেষ করে যখন কৌতুক চিত্র আঁকি তখন নারায়ণ দেবনাথ নিজের অজান্তেই চলে আসেন। এক-একটি চরিত্র ফুটিয়ে তোলা ও তার পাশাপাশি অভিব্যক্তি প্রকাশ করাটা শিখেছি ওঁর চিত্রকলা থেকেই।”

অন্য বিষয়গুলি:

Narayan Debnath
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE