শান্তিপুরের কাশ্যপপাড়ায়।
নদিয়া জুড়ে তখন বৈষ্ণব ধর্মের রমরমা। এ দিকে, নদিয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র শক্তির উপাসক। তিনি নবদ্বীপে শাক্ত রাসের প্রচলন করলেন। ক্রমে সে রাস সর্বজনীন হয়ে উঠল।
নদিয়ার আর এক ঐতিহাসিক শহর শান্তিপুরে বৈষ্ণব রাসের প্রচলন হল। দীর্ঘদিন সে রাস উৎসব ঠাকুর দালানের চার দেওয়ালে বন্দি ছিল। পরে চালু হয় বারোয়ারি রাস। তবে নবদ্বীপের মতো মূল রাস নয়, শান্তিপুরে রমরমা ভাঙা রাসের।
তবে শান্তিপুরের রাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজার জনশ্রুতি। তার কোনওটা ঐতিহাসিক, কোনওটা আবার পৌরানিক।
শান্তিপুরে রাসে ইতিহাস-গল্প মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শান্তিপুরের বাসিন্দারা মনে করেন, এই রাস আসলে সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষের মিলন মেলা। এক সময় বৈষ্ণবদের হাত ধরে শুরু হলেও, এখন তা সর্বজনীন। এখানকার ভাঙা রাসের শোভাযাত্রা, এমনকী কুঞ্জভঙ্গতেও নানান ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি এই উৎসবকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে।
শান্তিপুরে রাসের প্রচলন করেছিলেন অদ্বৈতাচার্য। জনশ্রুতি, তিনি ছিলেন শিবের অবতার। কথিত আছে, কৃষ্ণ একদিনে ষোলশ’ গোপিনীকে নিয়ে রাসে মগ্ন। সেই রাস দেখতে বড় লোভ হল মহাদেবের। ছদ্মবেশে শিব ঢুকলেন রাস দেখতে। কিন্তু ধরে ফেললেন কৃষ্ণ। প্রচণ্ড রেগে তিনি রাস প্রঙ্গন ছেড়ে চলে গেলেন।
মহাদেবের আর রাস দেখা হল না। শিব ঠিক করলেন যে, তিনি মর্ত্যের মানুষকে রাস দেখাবেন। তাই শিব অদ্বৈতাচার্যের রুপ ধরে মর্ত্যে এলেন। তার হাত ধরে শুরু হল রাসের।
সাজানো হচ্ছে মদনগোপালকে। শান্তিপুরের মদনগোপাল বাড়িতে।
এ যদি কল্পকাহিনী হয়, তবে শান্তিপুরের রাসের সঙ্গে ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসও। রাসের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বারো ভুঁইঞার এক ভুঁইঞা প্রতাপাদিত্য পুরীর রাজা ঈন্দ্রদ্যুম্নের আমলে পুজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহ যশোরে নিয়ে আসেন। কিন্তু মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে প্রতাপাদিত্য সেই বিগ্রহ তুলে দেন বারো ভুঁইঞাদের গুরু অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে।
তিনি সেই বিগ্রহকে শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধা রমণ জিউ নামে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু মথুরেশ গোস্বামীর মৃত্যুর পর এক দিন চুরি হয়ে গেল সেই রাধা রমণ জিউ এর বিগ্রহ। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর স্থানীয় দিগনগরের এক বিল থেকে উদ্ধার হল সেই বিগ্রহ।
এই ঘটনায় গোস্বামী পরিবারের সদস্যদের মনে হয়, শ্রীকৃষ্ণ এখানে একা আছেন বলেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে। আর তাই প্রতিষ্ঠা করা হয় রাধিকা মূর্তির। রাসের দিনে মিলিত হয় সেই দুই মূর্তি। গোস্বামীদের শিষ্য খাঁ চৌধুরি বাড়ি প্রস্তাব দেয়, এই যুগল মূর্তি শোভাযাত্রা করে দেখানো হোক শহরের বাসিন্দাদের। মূলত তাদেরই উদ্যোগে বের হয় শোভাযাত্রা। সেই শুরু ভাঙারাসের।
বড় গোস্বামী বাড়ির বর্তমান বংশধর সত্যনারায়ণ গোস্বামী জানান, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবদ্বীপে শাক্তরাসের প্রচলন করার পরেই শান্তিপুরেও বারোয়ারি রাসে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল সকলে। রাসকে আকর্ষণীয় করতে, দর্শনার্থীদের আবার নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরমুখী করতে বিভিন্ন বারোয়ারির মাধ্যমে রাসের শোভাযাত্রা শুরু হয়। আবার অনেকে মনে করেন, বিগ্রহ বাড়িগুলিতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই শুরু হয় রারোয়ারি রাসের।
বর্তমানে একাধিক বিগ্রহ বাড়িতে রাস হয়। তার মধ্যে অদ্বৈতাচার্যের বংশের বিভিন্ন শাখার একাধিক বাড়ির রাস এখনও সমান জনপ্রিয়। বিশেষ করে বড় গোস্বামী বাড়ির রাস শান্তিপুরের রাসের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এই বাড়ির পাশাপাশি মধ্যম গোস্বামী বাড়ি, ছোট গোস্বামী বাড়ি-সহ মদনগোপাল গোস্বামী বাড়ি, পাগলা গোস্বামী বাড়ি, আতাবুনিয়া গোস্বামী বাড়ি, বাঁশবুনিয়া গোস্বামী বাড়ি। গোস্বামী বাড়িগুলি ছাড়াও খাঁ চৌধুরী বাড়ি, সাহা বাড়ি, বংশীধারী ঠাকুর বাড়ি, মঠ বাড়ি, আশানন্দ বাড়ি, রায় বাড়ি, কালাচাঁদ বাড়ি, প্রামানিক বাড়ি, গোস্বামী-ভট্টাচার্য বাড়ি, গোপীনাথ জিউ ঠাকুর বাড়ি, মুখোপাধ্যায় বাড়ির রাস বিশেষ উল্লেখ যোগ্য। এর বাইরেও একাধিক বিগ্রহ বাড়িতে এখনও যথেষ্ট ধুমধামের সঙ্গে রাস হয়।
শান্তিপুরের বৈষ্ণবপাড়ায়।
শান্তিপুরের বেশ কিছু বারোয়ারি রাসের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। বড় গোস্বামীপাড়া বারোয়ারি, লক্ষ্মীতলাপাড়া বারোয়ারি, তিলিপাড়া স্বেত সংঘ, বাইগাছিপাড়া নব মিলন সংঘ, শান্তিপুর রামকৃষ্ণ কলোনী, ভদ্রকালী, বাইগাছি পাড়া সত্যনারায়ন, ঘোষপাড়া, শ্যামচাঁদ মোড়, শান্তিপুর কামারপাড়া, তামাচিকে পড়া, শাম্তিপুর শ্যামবাজার, শান্তিপুর লিডার্স ক্লাব, শান্তিপুর বউবাজার পাড়া, ঠাকুর পাড়া লেন আ্যমোচার ক্লাব এবং প্যরাডাইস ক্লাব, শান্তিপুর গোডাউন মাঠের ত্রিপদ নারায়ণ।
১৭টি বিগ্রহবাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ভাঙারাসের শোভাযাত্রায় বের হয় প্রায় ৫৯টি ক্লাব-বারোয়ারি।দিন দিন আলোর রোশনাই আর জৌলুশে ভাঙারাসের শোভাযাত্রা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। আসেন বিদেশের পর্যটকরাও।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য, কল্লোল প্রামাণিক, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy