লড়াই এখন পাড়ায় পাড়ায়!
সবাই সবাইকে চেনে। সম্পর্ক ভাল। রোজ বিকেলে চা খেতে গিয়ে দেখাও হয়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী—তর্ক জমে ওঠে। কিন্তু পুজোর কথা উঠলেই সক্কলে চুপ। পেটে বোমা মারলেও কিস্যু বেরোবে না!
কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে একজন বলছেন, ‘‘সিক্রেট দাদা, সিক্রেট। মণ্ডপে আসুন, সব বলব। এখানে নয়।’’
আর একজন বলছেন, ‘‘রাখুন তো ওদের সিক্রেট। সবাই জানে ওরা কী করছে। চমক তো দেব আমরা। মিলিয়ে নেবেন।’’
অসুর-দুর্গার লড়াইয়ের এখনও ক’দিন বাকি আছে। কিন্তু পাড়ার ‘লড়াই’ জমজমাট।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বড় বাজেটের পুজো প্যান্ডেলের আশপাশে কান পাতলেই সেই লড়াইয়ের ঝাঁঝও টের পাওয়া যাচ্ছে।
—‘গোটা রাস্তা আলোয় আলোয় সাজিয়ে দেব। পারবে ওরা?’
—‘পুজোর চার দিন সন্ধ্যার পরে জাঁকিয়ে অনুষ্ঠান। দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যাবে।’
—‘হুঃ, আমাদের মণ্ডপ এ বার বিখ্যাত এক মন্দিরের আদলে। জোড়া অসুর। আছে দম?’
চায়ের কাপটা বেঞ্চের উপরে ঠক করে রেখে বেথুয়াডহরির কাঁঠালবেড়িয়া দীননাথ পাঠাগার সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সহ সভাপতি রতন দে বলছেন, ‘‘ও সব পুরনো হয়ে গিয়েছে দাদা। হামারে পাস ওয়াইফাই হ্যায়। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত। এক্কেবারে ফ্রি।’’
বেথুয়াডহরির টাউন ক্লাবও পিছিয়ে নেই। জেন ওয়াই দর্শকের কথা মাথায় রেখে ও ভিড় টানতে ক্লাব কর্তারাও ভরসা রেখেছেন ওয়াইফাইয়ের উপরে।
মুর্শিদাবাদের নিমতলা দুর্গামন্দির সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির উদ্যোক্তারাও পুজোর চার দিন মণ্ডপের একশো মিটার এলাকাকে ফ্রি ওয়াইফাই জোন করে দিচ্ছেন।
কিন্তু পুজো মণ্ডপে হঠাৎ ওয়াইফাই কেন?
উত্তর একটাই — ভিড় টানতে হবে।
কৌশলটা নতুন নয়। সম্প্রতি এই দুই জেলার বেশ কয়েকটি ক্লাব ও গ্রাম পঞ্চায়েতে নিখরচায় ওয়াইফাই চালু করা হয়েছে। বহরমপুরের একটি পানের দোকানের মালিক আবার ভিড় সামাল দিতে ওয়াইফাই চালু করেছে। তবে পুজো মণ্ডপে ওয়াইফাই অভিনব বলেই দাবি উদ্যোক্তাদের।
কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ, কল্যাণী, রানাঘাট, বাদকুল্লা, বহরমপুর, ডোমকল, জলঙ্গি কিংবা জঙ্গিপুরের মতো এলাকায় বেশ কয়েক বছর ধরেই থিমের পুজো হচ্ছে। প্রতি বছর বড় বাজেটের পুজো করে চমক দিচ্ছে মুর্শিদাবাদের আয়েসবাগ সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। এ বারেও তাদের বাজেট প্রায় দেড় কোটি টাকা। জেলা জুড়ে ওই পুজোর জোর প্রচারও চলছে।
কিন্তু ওয়াইফাই?
নাহ্, সে রাস্তায় তারা হাঁটেনি।
আর ঠিক সেই জায়গাটাই ধরেছে আয়েসবাগ থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিমি দূরের নিমতলা দুর্গামন্দির সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি।
পুজো কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পিলু ঘোষ ও সুমন সাহা কোনও রাখঢাক না করেই জানাচ্ছেন, প্রায় দেড় কাঠা জমির উপরে তাঁদের মণ্ডপ হচ্ছে। এ বারের থিম নির্মল বাংলা। মণ্ডপে থাকছে ১১ টি স্টল।
৫৫ বর্গফুটের সেই এক একটি স্টলে থাকছে গ্রাম বাংলার নানা দৃশ্য—কামারশালায় হাঁপর টানবেন কারিগর, ধান রুইবেন কৃষক, ঢেঁকিতে ধান ভানবেন প্রৌঢ়া। উদ্যোক্তাদের দাবি, কোনও মূর্তি নয়, সবটাই হবে জীবন্ত। এ বারের বাজেট প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু এত আয়োজন সার্থক হবে যখন মণ্ডপে ভিড় হবে।
উদ্যোক্তাদের কথায়, ‘‘সেই কারণেই ওয়াইফাই। এখন প্রায় সকলের ফোন স্মার্ট। মণ্ডপে এসে দর্শনার্থীরা মোবাইলের ওয়াইফাই অন করলেই এই সুবিধা পাবেন। বেশ কিছুক্ষণ এখানে সময়ও কাটাতে পারবেন।’’
একই বক্তব্য দীননাথ পাঠাগার পুজো কমিটির রতনবাবু ও বেথুয়াডহরির টাউন ক্লাব পুজো কমিটির সম্পাদক চন্দ্র ধরের।
পুজো মণ্ডপে ওয়াইফাইয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত জেন ওয়াই। তাঁরা জানাচ্ছেন, পুজো মণ্ডপে নিখরচায় ওয়াইফাই থাকলে তো আর চিন্তাই নেই। সেল্ফি থেকে ফেসবুক সবই চলবে ইচ্ছে মতো।
আর ঠিক এই ভয়েই ওয়াইফাইয়ের কথা ভেবেও পিছিয়ে এসেছে বাদকুল্লার অনামি ক্লাব। ৫১ বছরের এই পুজো দেখতে প্রতি বছর ভিড় উপচে পড়ে। উদ্যোক্তাদের অন্যতম জওহর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এমনিতেই ভিড় সামাল দিতে হিমসিম খাই। ওয়াইফাই চালু করলে আরও সমস্যা হত। সেই কারণেই ওয়াইফাইয়ের পরিকল্পনা করেও আমরা পিছিয়ে এসেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy