বিরল: বাবলারির চিঁড়েকল।
বাঙালির ইতিহাসের আদিপর্বে নীহাররঞ্জন রায় লিখছেন “...কালবিবেক ও কৃত্যতত্ত্বার্ণব গ্রন্থে আশ্বিন মাসে কোজাগরী পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিড়া এবং নারকেলে প্রস্তুত নানাপ্রকারের সন্দেশে পরিতৃপ্ত করতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশাখেলায়।”
মধ্যযুগে চিঁড়েকে লোকপ্রিয় করতে বৈষ্ণব উৎসবের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ্বে পানিহাটিতে নিত্যানন্দের আগমণ উপলক্ষে ভক্ত রঘুনাথ দাসের বিখ্যাত ‘চিঁড়ে মহোৎসবে’ প্রচুর পরিমাণ চিঁড়ে, দই, কলা ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কিছু দিন পর নরোত্তম দাস আয়োজিত খেতুরীর প্রসিদ্ধ মহোৎসবেও চিঁড়েদই পরিবেশন করা হয়। তার পরই ভক্ত সাধারণের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় চিঁড়ে পাকাপাকি জায়গা করে ফেলল। জলখাবার থেকে শুরু করে উৎসবে-উপবাসে চিঁড়ে হয়ে উঠল প্রধান খাদ্য।
আরও পরের কথা। ভোজনরসিক মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রশ্রয়ে তৈরি হয়েছিল বহু নতুন ধরনের খাদ্যবস্তু। মহারাজ সন্তুষ্ট হলে সেই পদ প্রিয়জন-পরিজনদের না খাইয়ে ছাড়তেন না। এক বার কৃষ্ণনগরের গোপ সম্প্রদায়ের একটি অনুষ্ঠানে নদিয়ারাজকে মিহি চিঁড়ে, ক্ষীর, দই, কলা দিয়ে অ্যাপ্যায়িত করা হয়। শোনা যায় সেই থেকে মহারাজের অন্যতম পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছিল ক্ষীর, কলা দিয়ে চিঁড়ের ‘ফলার’।
রাজার পছন্দের খাবার বলে কি না জানা নেই, তবে পরবর্তী কালে নদিয়ার নবদ্বীপ-বাবলারি এবং বর্ধমানের শ্রীরামপুর নিয়ে গড়ে উঠেছিল রাজ্যের অন্যতম প্রধান চিঁড়ে উৎপাদক অঞ্চল। একটা সময় ছিল যখন নবদ্বীপ শহরের অলিতে গলিতে ছিল চিঁড়েকল। নবদ্বীপের প্রবীণ চিঁড়ে কলের মালিক খগেন্দ্রনাথ দাস জানান, আটের দশকেও নবদ্বীপে প্রায় সত্তর থেকে আশিটা চিঁড়েকল ছিল। কিন্তু এখন একটিও নেই। যে ক’টা আছে সবই বাবলারিতে। এসটিকেকে রোডের উপর হেমায়েতপুর মোড় থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে ছোটবড় মিলিয়ে খান চল্লিশেক চিঁড়েকল ছিল। এখন সব মিলিয়ে মেরেকেটে বারো-তেরোটা। জানালেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চিঁড়ের কারবারি জগন্নাথ আইচ।
কিন্তু কেন এমন হাল? জবাবে খগেন্দ্রবাবু বলেন, “শহরের মানুষ যে দিন থেকে ফাস্টফুড চেখেছে, সে দিন থেকেই চিঁড়ে বা অনান্য চিরাচরিত খাবারের দিন গিয়েছে। গরমের দিনে আম-চিঁড়ে, দই-চিঁড়ে কিংবা কলা-চিঁড়ের মতো খাবার এখন কেউ খেতে চান না। মঠ-মন্দির, চটকল, পাথরখাদানের শ্রমিকেরাই প্রধান ক্রেতা।”
অথচ এক সময়ে মুর্শিদাবাদের কান্দি, বহরার মতো অঞ্চলে মহিলারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করতেন ধান। তার পর ঢেঁকিতে সেই ধান কুটে চিঁড়ে করে দিয়ে যেতেন। এক সের ধানের বিনিময়ে মিলত এক পোয়া চিঁড়ে। গরম কালে কাঁচা চিঁড়ে জলে ভিজিয়ে একটু চিনি, নুন এবং পাতিলেবুর রস দিয়ে খাওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল সকলের।
একরাশ মনখারাপ নিয়ে পুরানো দিনের কথা প্রসঙ্গে বহরার আশারাণী দাস বলেন “ঢেঁকিছাঁটা চিঁড়ে হত মোটা। অনেক ক্ষণ পেটে থাকত। এখন কলের চিঁড়ের সেই স্বাদ কোথায়?”
জঙ্গিপুর অঞ্চলে চিঁড়ের ব্যবসা মাত্র মাস চারেকের। কার্তিকে নতুন ধান উঠলে ক’মাসের জন্য চিঁড়েকল চালু থাকে। তার পর বন্ধ। তবে গ্রাম প্রধান নিমতিতা, সমশেরগঞ্জ বা সাগরদিঘিতে মিষ্টির দোকানে চিঁড়ে-দই কিছু বিকোয়। তবে ফরাক্কা থেকে বহরমপুরে চিঁড়ের দেখা মেলাই ভার।
তা হলে চিঁড়ে উৎপাদন কি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাবে? উত্তরে জগন্নাথ আইচ বা খগেন্দ্রনাথ দাসেরা জানান চিঁড়েকল কমে যাওয়ার সঙ্গে উৎপাদনের কোনও সম্পর্ক নেই। চিঁড়ের মূল ক্রেতা এখন চানাচুর কোম্পানি। প্যাকেটবন্দি চিঁড়েভাজাও খুব জনপ্রিয়। ফলে প্রতি দিন প্রচুর চিঁড়ে উৎপাদন হচ্ছে। আর চিঁড়েকল সংখ্যায় কমলেও আধুনিক হয়েছে। আগে একটা চিঁড়েকলে খুব বেশি হলে দিনে পাঁচ কুইন্ট্যাল চিঁড়ে হত। এখন আধুনিক চিঁড়েকল দিনে ষাট-সত্তর কুইন্ট্যাল চিঁড়ে উৎপাদন কোনও ব্যাপারই নয়। চানাচুরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চিঁড়েই এখন ভরসা ব্যবসায়ীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy