গান গাইছেন শিল্পীরা।—নিজস্ব চিত্র।
এখন চৈত্র মাস, হিসাবের মাস। কড়ায়গণ্ডায় আয়ব্যয় বুঝে নেওয়ার সময়। সংক্রান্তিতে সব হিসেব চুকিয়ে হিসেবের খাতা ‘হাল’ বা নতুন করতে হবে। তবে জমাখরচের হিসাব যখন চাওয়া হয় খোদ রাজ্যের শাসক দলের কাছে তখন সে হিসাব হয়ে ওঠে লোকগানের বিষয়বস্তু। সম্প্রতি সিবিআই তৃণমূলের কাছে তাঁদের বিগত কয়েক বছরের জমাখরচের হিসেব চেয়ে পাঠিয়ে তুমুল শোরগোল ফেলে দিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। বছর শেষে রাজনীতির সেই আঁচ লেগেছে গাঁ-গঞ্জের বোলানেও।
পরনে সাদা ধুতি আর রঙিন পাঞ্জাবি। কোমরে জড়ানো উত্তরীয়। খালি পায়ে জড়ানো ঘুঙুর। জনা দশেকের একটা দল। কারও গলায় ঢোল, কারও হাতে কাঁসি, কারও আবার খঞ্জনী। মূল গায়ক গাইছিলেন, ‘‘শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন/ ওগো এই আসরে দিদির কথা করিব বর্ণন/ এগারো সালের পরিবর্তনে দিদি যখন এলেন/ গদিতে বসেই অনেক কিছু দেওয়ার কথা বলেন/ আমরা সবাই বোলান শিল্পী, কৃষ্ণপুরে বাড়ি/ ওগো বাম আমলে পরিচয় পেতে করেছি কত ঘোরাঘুরি/ দিদির আমলে পেলাম আমরা শিল্পী পরিচয়...।’’ সহ গায়কেরা ধুয়ো ধরলেন— ‘‘ওগো সেই সঙ্গে হাজার টাকা, শুনুন মহাশয়/ আহা শুনুন মহাশয়।’’ নদিয়ার নিজস্ব ‘বোলান’ গানে এ ভাবেই চৈত্র সংক্রান্তি জমজমাট হয়ে উঠেছে।
তবে নিছক খুশি করা গান বেঁধে থামতে নেই বোলান শিল্পী বা ‘বালাদের’। প্রতি বছর তাঁরা নতুন নতুন গান বাঁধেন সমকালীন বিষয়ে। কাউকে রেয়াত করে না বোলানের বুলি। এ বার তাঁদের গানে একদিকে যেমন কন্যাশ্রী, শ্রমিক মেলা, বার্ধক্য ভাতা, সবার শৌচাগারের অকুন্ঠ প্রশংসা। তেমনি অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষাত্মক সমালোচনা ঝরে পড়ে তাঁদের গানে। সমাজের কঠোর সমালোচক বোলান শিল্পীরা চৈত্রের শেষ বিকেলে গাজনতলায় নতুন গান শুনতে জড়ো হওয়া শ্রোতাদের সামনে সদর্পে গেয়ে ওঠেন—‘‘এত কিছু করার পরেও মন্ত্রী গেলেন জেলে/ ওগো অনেক নেতা ধরা পড়ল সিবিআই জালে/ চৈত শেষে হিসাবপত্র বুঝে নিতে তাই/ সিবিআই হানা দিল তৃণমূলের দরজায়/ এত বড় দুঃখের কথা শুনতে হল ভাই/ আমরা সবে লোকশিল্পী বোলান গান গাই...।’’ গানের শেষে সোল্লাসে ফেটে পড়ল গোটা গাজন তলা।
নদিয়ার নিজস্ব লোকগান এই বোলান বা স্থানীয় লোকের মুখে ‘বুলান’। ফসলহীন চৈত্রের অলস অবসর কাটাতে সেই কবে নদিয়ার কৃষক শুরু করেছিলেন গান। ধুলো মাখা পায়ে ঘুঙুর জড়িয়ে দল বেঁধে ঢোলকাঁসি নিয়ে নেমে পড়েছিলেন পথে। কৃষকের অবসরের সেই গান ক্রমে বছর শেষের ‘চৈত্র গাজনের’ প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠল নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি বা কালীনগর, নাকাশিপাড়া, তেহট্টের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। গাজনের সন্ন্যাসী বা ‘গাজুনে বালার’ গান বলে এই গানের নাম বোলান বা বুলান।
শুরুতে পুরান থেকে রামায়ন, মহাভারত হয়ে কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা এ সবই ছিল বোলান গানের বিষয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বোলান। বিনোদনের বোলান হয়েছে উঠেছে প্রতিবাদের গান। গ্রামজীবনের অভাব অভিযোগ অবিচারের কথা থেকে শুরু করে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্ব হয়ে সারদা, সিবিআই সবই উঠে এসেছে নির্ভীক গায়কের গলায়।
কাউকে খুশি করার গান গাইতে জানেন না বুদ্ধিশ্বর ঘোষ, নিমাই ঘোষ, প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ বা স্বপন ঘোষের মতো চার পুরুষের বোলান গায়কেরা। তাই ওঁদের কথাও কেউ সে ভাবে ভাবে না। তবু চৈত্রের দুপুরে চূর্ণীর পারে যদি কখনও কানে আসে বাংলা ঢোলের গম্ভীর আওয়াজ, নিশ্চিত জানবেন কৃষ্ণগঞ্জ, পাবাখালি বা কৃষ্ণপুরের কোন গৃহস্থের উঠোনে বসেছে বোলানের আসর। নদিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ বোলান শিল্পী পুঁটিরাম ঘোষের বয়স ৮০ পেরিয়ে গিয়েছে। পুরুষানুক্রমে তিনি গাইছেন এই গান। তাঁর ছেলে ভীষ্মদেব ঘোষও এখন ভাল গাইছেন। আবার তরণী ঘোষ, গণেশ ঘোষের যোগ্য উত্তরসূরি বছর তিরিশের স্বপন ঘোষ নেমে পড়েছেন বোলান গাইতে।
তাঁদের সাফ কথা, “আমরা বোলান হারাতে দেব না।” অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং বোলান শিল্পী বুদ্ধিশ্বর ঘোষ বলেন, “খেটে খাওয়া মানুষের গান হল বোলান। সারাদিন জমিতে অমানুষিক পরিশ্রমের পর যাঁরা বাপ ঠাকুর্দার হাত ধরে বোলান গাইছেন তাঁদের তো কাউকে খুশি করার দরকার নেই। কেননা তাঁরা জানেন পেটের ভাতের জন্য সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম ছাড়া অন্য কিছু পথ নেই। সুতরাং সত্যি কথা বলতে বোলান শিল্পী ভয় পান না। লোকশিল্পী হিসেবে পরিচয়পত্র বা হাজার টাকা ভাতার কথাও যেমন আমরা প্রকাশ্যে বলে সুখ্যাতি করি। তেমনি খারাপ কাজের সমালোচনা করতেও ছাড়ি না। এটাই নদিয়ার বোলানের বিশেষত্ব। ”
সব বোলান গায়কের আদিগুরু প্রহ্লাদ পাটনি সেই কবে সুরে কথা বেঁধে তাঁর গ্রামের গলায় তুলে দিয়েছিলেন অবসর বিনোদনের অত্যাশ্চর্য এক উপায়। তারপর থেকে বোলান নদিয়ার নিজস্ব সম্পদ হয়েই রয়ে গিয়েছে। যদিও মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমানেও বোলান গাওয়া হয়। তবে ‘‘গুরুর নাম প্রহ্লাদ পাটনি, কৃষ্ণপুরে বাড়ি/ তাঁর চরণ স্মরণ করে দেশবিদেশে ঘুরি/ নদিয়া জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণগঞ্জ থানা/ ডাকঘর হয় শিবনিবাস, এই তাঁর ঠিকানা।’’ আসরের শুরুতে এইভাবে গুরু বন্দনা করে বোলান গাইতে পছন্দ করেন নদিয়ার শিল্পীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy