Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
অকালমাতৃত্ব/ ১
Underage Pregnancy

বাড়ছে নাবালিকা প্রসূতি

পুলিশ-প্রশাসন বার বার নাবালিকা বিয়ে বন্ধে জোর দিচ্ছে। তার পরেও জেলায় উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা। চিকিৎসকদের মতে, এই প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মা হচ্ছে কিশোরী শরীর। ফল, মৃত্যু মায়ের, অপুষ্ট শিশু। বিঘ্নিত হচ্ছে শৈশবের অধিকার।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:১২
Share: Save:

প্রসূতির বয়স মাত্র পনেরো। অচৈতন্য অবস্থায় তাকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে এল পরিবারের লোকজন। সঙ্গে অস্বাভাবিক খিঁচুনি। নাবালিকাকে বাঁচিয়ে রাখাই তখন চিকিৎসকদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ। শুরু হল প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। কিছুটা বিপন্মুক্ত মনে করে, অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই কিশোরীকে তোলা হল অপারেশন থিয়েটারে। সিজ়ার হল। নাবালিকা জন্ম দিল পুত্রসন্তানের। কিন্তু নাবালিকার মায়ের বিপদ কাটল না। যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। অন্য দিকে, সদ্যোজাতেরও ওজন খুব কম, মাত্র এক কেজি আটশো গ্রাম। তারও কী হয় কী হয় অবস্থা।

প্রায় ১২ দিন যুদ্ধ চলার পর নাবালিকা প্রসূতির অবস্থা স্থিতিশীল হয়। জেলা সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ভবতোষ ভৌমিক বলেন, “১২টা দিন আমরা লড়াই করেছি। কার্যত যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল মেয়েটাকে।” তাঁর আরও দাবি, “এই জটিলতা বা বিপদের প্রধান কারণ হল— মেয়েটি নাবালিকা অবস্থায় অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল। নাবালিকা প্রসূতির ক্ষেত্রে সব সময়েই মায়ের পাশাপাশি সন্তানেরও বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। এ ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটছে।”

জেলার স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের কথায়, ২০১৯ সালের পর থেকে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়, জেলায় যত জন প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে, তার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা। ভবতোষ ভৌমিকের কথায়, “করোনার পর নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ প্রসবের সংখ্যাও। এই প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২-২৩ সালে নদিয়া জেলায় ১১ হাজার ১১২ জন নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। শতাংশের বিচারে প্রায় ১৬ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সংখ্যাটা ৭৪৫২ জন, প্রায় ১৯ শতাংশ। অর্থাৎ, দিন দিন সংখ্যাটা বাড়ছে। স্বাস্থ্য কর্তারা জানাচ্ছেন, নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে না পারলে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা বা নাবালিকা প্রসূতির সংখ্যা কমানো যাবে না। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে জেলার পুলিশ-প্রশাসনের একাধিক কর্মসূচি আছে। আছে জেলার শিশু সুরক্ষা দফতর, আছে শিশু কল্যাণ কমিটি। সেই সঙ্গে আছে আস্ত এক সমাজকল্যাণ দফতর। সচেতনতার জন্য প্রচারের পাশাপাশি পুলিশের হাতে আছে নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন। আছে কন্যাশ্রীর মতো মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। তার পরেও কেন জেলার নাবালিকাদের এমন করুণ অবস্থা? সেখানেই নতুন করে প্রশ্ন উঠছে— তা হলে কি সংশ্লিষ্ট দফতর, পুলিশ-প্রশাসন নিজের নিজের দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছে না?

পরিসংখ্যান জানাচ্ছেন, করোনা অতিমারির সুযোগে জেলার বেশ ভাল সংখ্যক নাবালিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২৩ সালে নদিয়া জেলায় ৪৫০ জন ও ২০২২ সালে প্রায় ৩৯০টি নাবালিকা বিয়ে আটকাতে পেরেছে প্রশাসন। যদিও প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, স্কুলের পাশাপাশি গ্রামে-গ্রামে লাগাতার সচেতনতা শিবির করার জন্য মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। সেই কারণেই আগের চেয়ে বেশি নাবালিকা বিয়ের খবর আসছে। আর নাবালিকা বিয়ে আটকানোর সংখ্যাও বাড়ছে।

স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলছে না। কারণ, নাবালিকা বিয়ে বন্ধের সংখ্যা যদি বাড়ে, তা হলে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বার সংখ্যা কমার কথা। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। নাবালিকা বিয়ে নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থার কর্মীরা দাবি করছেন, যে ক’টি নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, সেটি আসলে হিমশৈলের চূড়ামাত্র। গ্রামেগঞ্জের পাশাপাশি শহর এলাকাতেও এখনও নাবালিকা বিয়ের ঘটনা হামেশাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে সব নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তীতে সেই নাবালিকাকে একই পাত্রের সঙ্গে, অন্যত্র নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে খবর রাখছে না কেউই।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Health Department
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy