Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

হোমগার্ডের চাকরিতে টাকা দিতে না পুলিশের

ওঁদের অনেকে ঠিক করে ফেলেছিলেন, টাকাটা দিয়েই দেবেন।টাকার অঙ্কটা নেহাত কম নয় চার লাখ। কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ প্রবাসী দাদা-বৌদির কাছে চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড় করছিলেন। হোমগার্ডের চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা?

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০২:০৩
Share: Save:

ওঁদের অনেকে ঠিক করে ফেলেছিলেন, টাকাটা দিয়েই দেবেন।

টাকার অঙ্কটা নেহাত কম নয় চার লাখ। কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ প্রবাসী দাদা-বৌদির কাছে চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড় করছিলেন। হোমগার্ডের চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা? কিন্তু টিভিতে কেব্ল চ্যানেলে বিজ্ঞাপনটা ওঁদের চোখে পড়ে যায় ‘বিশেষ ঘোষণা: মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের তরফ থেকে জানানো যাচ্ছে যে, যে সমস্ত যুবক ও যুবতী হোমগার্ড পদে ইন্টারভিউয়ে ডাক পেয়েছেন তাঁরা কোনও দালাল বা ঠকবাজদের ফাঁদে পা দেবেন না। নিয়োগ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ভাবে করা হচ্ছে। যদি কেউ ঠকবাজদের প্ররোচনায় পা দেন, তা হলে তাঁর প্রার্থিপদ বাতিল করা হবে ও ঠকবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ডোমকল মহকুমা পুলিশ।’

দেখে তো ওঁদের চোখ কপালে! এই যে তৃণমূল নেতা বাড়িতে এসে বলে গেলেন, “চাকরিটা সত্যি চান? লাখ চারেক খরচা করলেই হয়ে যাবে। দাদার কোটা আছে। সেখান থেকে আপনারটা করে দেব। এটাই শেষ কোটা। কাউকে বলবেন না কিন্তু!” সেটা তবে ধোঁকা?

টেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের চাকরি থেকে কলেজে ভর্তি, ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের শাসকদলের লোকজনের বিরুদ্ধে। একই অভিযোগ উঠছে মুর্শিদাবাদে হোমগার্ড নিয়োগের ক্ষেত্রেও। জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর অগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হওয়া শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষায় ৭২ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৯,৫১৫ জন। আগামী ১৮ জুলাই থেকে তাঁদের মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ৩০০ জনকে বাছাই করা হবে। পরীক্ষার্থীরা চিঠিও পেয়ে গিয়েছেন।

জেলা পুলিশের কাছে খবর, পরীক্ষার্থীদের বাড়ি-বাড়ি মৌখিকের চিঠি যেতেই কিছু তৃণমূল নেতার যাতায়াতও শুরু হয়ে গিয়েছে। চার লাখ টাকা দিলেই চাকরি হয়ে যাবে জানিয়ে তাঁরা আশ্বাস দিচ্ছেন, “চিন্তার কী আছে মশাই! চাকরিটা তো পুলিশের। খুব বেশি হলে বছরখানেক সময় লাগবে ওই টাকা তুলে নিতে।” ডোমকল, জলঙ্গি ও ইসলামপুর থেকে বেশি অভিযোগ আসছে।

জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “দালালেরা টাকার বিনিময়ে হোমগার্ডের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এদের ফাঁদে যাতে কেউ পা না দেয়, তার জন্য ডোমকল মহকুমা এলাকায় কেব্ল চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। জেলা জুড়ে মাইকেও প্রচার করা হবে।”

তবে শাসকদলের নেতারাই টাকা চাইছেন কি না, সে ব্যাপারে অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।

টিভিতে বিজ্ঞাপনটা প্রথমে দেখে চমকে গিয়েছিলেন জলঙ্গির সাদের আলি (নাম পরিবর্তিত)। বৃদ্ধ জানান, দিন কয়েক আগে একটি রাজনৈতিক দলের জনাকয়েক এসেছিলেন। এক নেতার নাম করে তাঁরা বলেল, ‘দাদার হাতেই চাকরি। পুলিশের কাছে দাদা যার নাম পাঠাবে, তারই চাকরি হবে।’ তবে তার জন্য আগাম তিন লাখ এবং চাকরির পরে এক লাখ দিতে হবে।

সাদের আলি বলেন, “ওই কথায় বিশ্বাস করে আমার ছেলে তার ছবি, কাগজপত্র সবই ওদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমিও জমি বিক্রির জন্য একেবারে তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, টিভিতে বিজ্ঞাপনটা দেখতে পেয়েছি!” রানিনগরের এক বাসিন্দার ব্যাখ্যা, “আসলে, ওরা যাদের নাম করছে তারাই তো এখন রাজ্যের সব!” ওই এলাকারই এক যুবক বলেন, “চার লক্ষ টাকা দেব মনস্থির করে সৌদি আরবে দাদার কাছে চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। টিভিতে বিজ্ঞাপনটা দেখার পরেই ভুল ভাঙল।”

ডোমকলের কংগ্রেস নেত্রী তথা লালবাগের বিধায়ক শাওনি সিংহ রায়ের কটাক্ষ, “এখন চাকরি থেকে বদলি সব কিছুতেই তো দালালি দিতে হচ্ছে। রাজ্যের মানুষের কাছে এর থেকে বড় লজ্জা কী হতে পারে?” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নারায়ণ দাসের দাবি, “নাম না করলেও পুলিশ জানে, কারা টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলছে। তবু তারা যে শাসকদলের তোয়াক্কা না করে মানুষকে একটা বার্তা দিয়েছে, এর জন্য পুলিশকে ধন্যবাদ দেব।”

তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের সভাপতি চাঁদ মহম্মদ অবশ্য দাবি করেন, “কেউ যদি দোকানে গিয়ে আমার নামে মিষ্টি খায়, তাহলে যেমন আমার কিছু করার নেই, তেমনই কেউ কোনও তৃণমূল নেতার নাম ভাঙিয়ে টাকা তুললেও কিছু করার নেই। আমাদের কেউ এমন করলে পুলিশ গ্রেফতার করুক।”

তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যবেক্ষক ইন্দ্রনীল সেন বলেন, “পুলিশ ভাল কাজই করছে। তবে আমাদের কেউ টাকা তুলছে বলে বিশ্বাস হয় না। যদি তা সত্যি হয়, দলীয় স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সহ-প্রতিবেদন: অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

অন্য বিষয়গুলি:

no pay homeguard police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE