Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

প্রচারের ঢক্কায় কান নেই বিড়ি তল্লাটের

পাশের সড়ক দিয়ে বেরিয়ে গেল বিশাল মিছিলটা। মোটরবাইকের শব্দ বা মিছিলের স্লোগান, কোনওটাই যেন কানে গেল না তাঁদের। লিচুতলার বাগানে গোল হয়ে বসে কুলোয় আড়াই পাকে ব্যস্ত বিড়ি বাঁধতে ব্যস্ত জনা পঁচিশ মহিলা। এক জন শুধু নিচু গলায় জানতে চাইলেন, “কারা গেল রে?” উত্তরটা এল তার চেয়েও নিচু স্বরে, “গরু পার্টি”। এ তল্লাটে ‘গরু পার্টি’ বলতে বোঝায় তৃণমূল। হইচই করে মিছিলটা চলে গেল বাজিতপুরের পথ ধরে।

বিমান হাজরা
অরঙ্গাবাদ শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৬ ০২:৫২
Share: Save:

পাশের সড়ক দিয়ে বেরিয়ে গেল বিশাল মিছিলটা। মোটরবাইকের শব্দ বা মিছিলের স্লোগান, কোনওটাই যেন কানে গেল না তাঁদের।

লিচুতলার বাগানে গোল হয়ে বসে কুলোয় আড়াই পাকে ব্যস্ত বিড়ি বাঁধতে ব্যস্ত জনা পঁচিশ মহিলা। এক জন শুধু নিচু গলায় জানতে চাইলেন, “কারা গেল রে?” উত্তরটা এল তার চেয়েও নিচু স্বরে, “গরু পার্টি”।

এ তল্লাটে ‘গরু পার্টি’ বলতে বোঝায় তৃণমূল। হইচই করে মিছিলটা চলে গেল বাজিতপুরের পথ ধরে।

বরাবরই কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে চিহ্নিত সুতি। ১৬ থেকে ১৭ হাজারের মার্জিন রেখে কংগ্রেসের জয় সুতিতে নতুন কিছু নয়। আগের নির্বাচনগুলিতেও এই বিড়ি শ্রমিক মহল্লাগুলি ছিল রীতিমতো সরগরম। সন্ধে হলেই বিভিন্ন দলের পতাকা ও ফেস্টুন হাতে ছোট-ছোট মিছিল বের হত নিত্যদিনই। কিন্তু এ বার শ্রমিক মহল্লার যেন মাথাব্যথাই নেই।

অথচ তিন জন বিড়ি মালিক এ বার ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন। জঙ্গিপুরে তৃণমূলের প্রার্থী জাকির হোসেন, সুতিতে একই দলের হয়ে ইমানি বিশ্বাস এবং সমশেরগঞ্জে নির্দল প্রার্থী হতে চলা বিক্ষুব্ধ তৃণমূল মন্টু বিশ্বাস। মালিকেরা দাঁড়ানোয় ভোট জোটানোর খেলায় ইতিমধ্যেই পুরোদস্তুর মাঠে নেমে পড়েছেন বিড়ি মুন্সিরা। প্রতি সপ্তাহে পাখি-পড়া করে কারিগরদের তাঁরা বুঝিয়ে চলেছেন, কোন প্রতীকে ভোট দিতে হবে। কিন্তু কারিগরদের মুখে রা নেই। যেমন নিরুত্তাপ অরঙ্গাবাদ, তেমনই ধুলিয়ান।

অরঙ্গাবাদে দৈনিক গড়ে প্রায় ৬০ কোটি বিড়ি উৎপাদন হয়। প্রতি বছর ভোট এলেই বিড়ি শ্রমিকদের সমর্থন পেতে তাই ঝাঁপিয়ে পড়ে সব দলই। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এক দফা প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁদের সেই সব সভাতেও বিড়ি শ্রমিকদের ভিড় সে ভাবে চোখে পড়েনি। কেন?

বাতাসে কান পাতলে প্রথম যে কারণটা শোনা যাচ্ছে, তা হল, বি়ড়ি শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে ঘনিয়ে ওঠা সংশয়। আগামী ১ এপ্রিল এ যাত্রা স্থগিত রইলেও বিড়ি শিল্পে ‘টোব্যাকো আইন’ এক দিন না এক দিন আসতেই চলেছে, তা বিলক্ষণ বুঝেছেন শ্রমিকেরা।

ঘটনা হল, সুতি আর সমশেরগঞ্জে ভোটারদের বেশির ভাগই বিড়ি শ্রমিক। জঙ্গিপুরের প্রায় ছ’লক্ষ বিড়ি শ্রমিকের বাস সুতি ও সামশেরগঞ্জ-সহ চার বিধানসভা কেন্দ্রে। সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, এঁদের মধ্যে ১০ ঘণ্টার বেশি খাটেন এমন শ্রমিকের সংখ্যা ৩৯ শতাংশ। অথচ তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশের আয় মাসে হাজার টাকারও কম। কখনও বাম, কখনও কংগ্রেসের উপরে ভরসা করে এসেছেন এঁরা। ন্যূনতম সরকারি মজুরির দাবি উঠেছে বারবার। আজও তা জোটেনি।

বামুহা গ্রামের সাবিনা বিবির খেদ, “ভোট আসে, ভোট যায়। আমাদের অবস্থার বদল ঘটে কই? বাড়িতে ছ’টা পোষ্য। স্বামী-স্ত্রী মিলে হাজার দেড়েক বিড়ি বাঁধি। দুশো টাকা আয়ে সংসার চলে? আগে মনে করতাম, ভোট দিলে হয়তো মজুরি বাড়বে। এখন আশা ছেড়ে দিয়েছি। তাই স্বামীকে আর মিছিলে যেতে দিই না। লাল পার্টিতে, গরু পার্টিতেও না।”

তেনাউড়ির কুমেদ শেখের কথা, “টোব্যাকো আইনের প্যাঁচে পড়ে বিড়ি মালিকেরা এখন অন্য ব্যবসায় নেমেছেন। বিড়ি শিল্পের আয়ু কমে আসছে। এত সংখ্যক বিড়ি শ্রমিকের কী হবে, কেউ ভাবছেন না।” শাসক দলের মিছিলের দিকে চেয়ে রুকুন বেওয়া বলেন, “গিয়ে দেখুন, মিছিলে একটাও বিড়ি শ্রমিক খুঁজে পাবেন না। অথচ এক সময়ে তিন টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য ছেলেরা পুলিশের লাঠি খেয়েছে, জেলে গিয়েছে! ”

বিড়ি মালিক সংগঠনের সম্পাদক রাজকুমার জৈনের মতে, “টোব্যাকো আইন বলবৎ হলে বিড়ি শিল্পের ঝাঁপ কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকেরা তা জানেন।” কংগ্রেসের বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, “শ্রমিকদের আশা ছিল, এলাকায় বিকল্প শিল্প গড়ে উঠবে। রুজির চিন্তাই ওঁদের ঘুম কেড়েছে।”

বিড়ি মালিকেরা তৃণমূল বা বিক্ষু্ব্ধ তৃণমূল হওয়ায় এর মধ্যেও রাজনীতি দেখছেন সিটুর জেলা সভাপতি আবুল হাসনাত খান। তাঁর মতে, “বিড়ি মালিকদের শোষণের শিকার শ্রমিকেরা। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি। এখন বিড়ি মালিকেরাই রাজনীতিতে ঢুকে ক্ষমতা কব্জা করতে চাইছে।”

মুখ বুজে থাকা শ্রমিকেরা ভোটের বুথে ঢুকে কী করবেন, সেই হিসেব অবশ্য কারও কাছে নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

vote campaign not interested Aurangabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE