Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

পদ্মপাতায় ঢেঁকি-ছাঁটা গরম ভাত

ভীষণ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গ্রামগঞ্জের চালু লব্জ ছিল—  ‘বিয়ে বলে জুড়ে দেখা! আর বাড়ি বলে ভেঙে দেখা!’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

ভীষণ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে গ্রামগঞ্জের চালু লব্জ ছিল— ‘বিয়ে বলে জুড়ে দেখা! আর বাড়ি বলে ভেঙে দেখা!’
আজকের দিনের মতো তখন ক্যাটারিং ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। চালকল, আটা কল ছিল, তবে কম। ছিল না চিঁড়ে ও ডাল কল। অতীতে বিয়ের ভোজের যাবতীয় উপকরণ বাডির লোকজনদেরই মজুত করতে হত। বিশেষত বাড়ির মহিলাদের ঘামঝরা মাসখানেকের মধ্যে কোনও ফুরসত জুটত না।
গভীর রাতে উঠে ঢেঁকি ভেঙে ধান থেকে চাল বের করতেন বাড়ির মহিলারা। সঙ্গে পড়শি। একই ভাবে চিঁড়ে দই-এর ফলারের জন্য ঢেঁকিতে চিঁড়ে কুটতেন মহিলারা। ভোর হতেই ঢেঁকি ফেলে নিত্যদিনের রান্নাবাড়ির কাজ করতে হত। ফলে মাসখানেক ধরে প্রতি দিন ভোর হওয়ার অনেক আগে তাঁদের পা পড়ত ঢেঁকিতে।
দুপুরের পর ঘরের দাওয়ায় বসে চাকি পিষে ডালের মজুত বাড়নো হত। ওই একঘেমিয়ে থেকে মন ও শরীরকে কিছুটা রেহাই দিতেন বিয়ের গীত জানা মহিলারা। সঙ্গে থেকে তাঁরা ধরতেন গান। তাঁদের বিয়ের গীতের সুরে রঙ্গ-তামাশায় দেহ ও মনের ক্লান্তি কিছুটা অপসৃত হত বইকি।
বিয়ের গীতে সরাসরি সেই ঢেঁকির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ঢেঁকিতে পা দিয়ে গাইতে থাকেন, ‘‘ঢেকি বয়ে উঠে বলে আমরা দু’টি ভাই/ আমরা না থাকিলে ঢেঁকি উল্টে যায়। চুরোন বেয়ে উঠে বলে আমরা একটি ভাই/ আমরা না থাকিলে ঢেঁকি উল্টে যায়।’’
লোকসংস্কৃতির গবেষক শক্তিনাথ ঝায়ের সংগৃহীত একটি বিয়ের গীতে উঠে এসেছে বিয়ের ভোজের জন্য ধানভাঙার যন্ত্রণার কথাও।
ঢেঁকিতে পা দিয়ে গ্রামীণ গীতিকার গাইতে থাকেন— চৈত বৈশাখীর খরানি রে মনরায় ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ আমার সিঁথের সিঁদুর ঘামিল কে মনরায়, ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ চৈত বৈশাখীর খরানি রে মনরায় ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ কোলের বালক ঘামিল রে মনরায়, ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ আমার নাকের বেশর ঘামিল রে মনরায়, ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ চৈত বৈশাখীর খরানি রে মনরায় ঢেঁকি পেতে দে ঘরে/ আমার হাতের বাজু ঘামিল রে মনরায়, ঢেঁকি পেতে দে ঘরে।
বিয়ের ভোজে মুসলমান পরিবারে সাধরণত মাংস রান্না হত। কিন্তু হিন্দু পারিবারে মাছের চাহিদা ছিল বেশি। এখন অবশ্য হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ উভয় সম্প্রদায়ের অবস্থাপন্ন পরিবারের বিয়ের ভোজে মাছ-মাংস দুটোরই আয়োজন থাকে।
খড়গ্রামের বছর ষাটেকের পশুপতি হালদার বলেন, ‘‘দ্বারকা ও ব্রহ্মাণী নদী পাড়ের গ্রামগুলোতে জেলেরা বিয়ে বাড়িতে সস্তায় মাছ সরবরাহ করতেন। নদী থেকে দূরের গ্রামে কারও পুকুর থেকে বিয়ে বাড়িতে মাছ যেত নামমাত্র দামে। এখকার মতো বরফ দেওয়া মাছ নয়। টাটকা মাছ।’’
সে কালে ভোজ খাওয়া হত কলাপাতায়। নয়তো পদ্মপাতায়। মুর্শিদাবাদ থানার তেঁতুলিয়া গ্রামের নিবারণ মণ্ডল বলেন, ‘‘একটু নাম কিনতে চাইলে কলাপাতার বদলে বরকর্তা, কনেকর্তারা পদ্মপাতায় ভোজ খাওয়াতেন। খাবারের সেই পাত্র, অর্থাৎ পাতা জোটানো বড় হ্যাপার কাজ ছিল। তখন কিন্তু এখনের মতো এত কলাবাগান ছিল না। পদ্মপাতাও আনতে যেতে হত গরুর গাড়ি চেপে দূরান্তের খাল-বিলে।
পুরনো মানুষেরা উদাস হয়ে সেই সব দিনের খোঁজ করেন অন্তরীক্ষে!

অন্য বিষয়গুলি:

Marriage Wedding
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy