যেখানে ছিল তলিয়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর। নিজস্ব চিত্র
‘‘ভাঁড় কাটে চাকে আর মাটি কাটে পাকে। বলুন তো এ কথার মানে কী?”
পাথুরে বাঁধনে আপাত শান্ত এক নদীর পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন বিফল ঘোষ। আকাশ-পাতাল ভেবে সেই গ্রাম্য হেঁয়ালির জবাব নেই দেখে ‘কুলু’ দিলেন তিনি। বলেন, “নদীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে দ্যাখেন। ওর জলেই উত্তর আছে।”
সে কথা শুনে আরও গুলিয়ে গেল। পাশে শ্রাবণের ভরন্ত গঙ্গা বইছে আপন মনে। বেকায়দা বুঝে অর্থটা পাশ থেকে বলে দিলেন নিমাই রাজবংশী। কুমোর চাক ঘুরিয়ে মাটি থেকে ভাঁড় তৈরি করে। আর নদীর জল ঘুরলেই জানবেন পাড়ের মাটি ধসে পড়বে। ভাঙন হবে।
নদী-বিজ্ঞানের এমন সহজপাঠ কেবল নদীপাড়ের মানুষেরই দিতে পারেন। যাঁদের অভিজ্ঞ চোখ জলের পাকের রকমফের দেখেই বুঝতে পারে ভাঙনের সঙ্কেত।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নদীকূলে বাস বিফল ঘোষ বা নিমাই রাজবংশীর। বাপ-ঠাকুরদার ভিটে, জমি, ধানের গোলা, তুলসী মঞ্চ—নদীর গ্রাসে সব খুইয়েছেন। তবে সব কিছু নিলেও নদী তাঁদের পড়তে শিখিয়েছে ভাঙনের স্বরলিপি। অনায়াসে বলে দেন, নদীর কোন পাকে হারিয়ে যাবে বসতি, জনপদ, ভূখণ্ডের সীমানা।
এখন নদীর পাড়ে এক চিলতে জমিতে বাড়ি বিফল ঘোষের। গঙ্গার দিকে আঙুল তুলে বিফল হিসেব দিচ্ছিলেন তিরিশ বছরে নদী কী কী খেয়েছে। তিনি বলেন, “যেখানে দাঁড়িয়েছি এটা ছিল আমাদের ধান জমির শেষ সীমানা। প্রায় দেড়শো মিটার দূরে ছিল এক বিঘার উপর বাগান-সহ পৈত্রিক বাড়ি। ছয় ভাই এক সঙ্গে থাকতাম। দশ বিঘা জমি, ফলের বাগান, ধানের গোলা, গোয়াল-গরু সবই ছিল। এখন কাঠা ছয়েক জমি পড়ে আছে।” চল্লিশ বছরে গঙ্গা নবদ্বীপ শহরের দিকে দেড় কিলোমিটারেরও বেশি সরে এসেছে। আসার পথে গিলেছে সব কিছু।
ভাঙনের আর এক গল্প শোনালেন হারাধন চক্রবর্তী। সময়টা ২০০৪। তখন তিনি যুবক। গঙ্গার ভাঙনে তখন নবদ্বীপের উত্তর প্রান্তে প্রাচীন মায়াপুরে ত্রাহি ত্রাহি রব। বর্ষার শেষে গঙ্গার জলস্তর একটু একটু করে নামছে। পাড় থেকে একটু ভিতরে নদীর জল এক বিরাট ব্যাসার্ধ নিয়ে পাক খাচ্ছে ক্রমাগত। লক্ষণ দেখে পাড়ের বাসিন্দারা প্রমাদ গুনছেন। এলাকার মানুষ বড় বড় গাছ, বাঁশের ঝাড় কেটে কেটে ফেলছেন নদীর জলে। ভাঙন রোধে এ এক চালু টোটকা। সন্ধ্যা নাগাদ যেন একটু থমকাল নদী। সবাই সামান্য স্বস্তি পেলেন। দিন ভর জলের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত গোটা পল্লি। হারাধনেরা ঠিক করেন রাতটা নদীর পাড়েই কাটাবেন। এলাকার এক প্রবীণ তাঁকে সতর্ক করেন রাতে ভাঙন হবে। প্রাণের ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই। যুবক হারাধন সে কথায় পাত্তা দেননি।
এত বছর পরেও সে রাতের কথা বলতে গিয়ে কেঁপে ওঠেন হারাধন। তিনি বলেন, “রাতে কিছু হয়নি। বিপদ এল কাকভোরে। প্রবল শব্দে বড় বড় মাটির চাঙড় ধসে পড়তে লাগল চারপাশ থেকে। ঘুমের ঘোরে প্রথমে বুঝতে পারনি। যখন হুঁশ ফিরল ততক্ষণ আমি যেখানে শুয়ে সেই অংশ মূল জমি থেকে আলগা হতে শুরু করেছে। বিছানা মাদুর ফেলে কোনও রকমে জলে লাফিয়ে প্রাণ বাঁচাই।” সে বার প্রাণটুকু ছাড়া প্রাচীন মায়াপুরের মানুষ বাঁচাতে পারেননি কিছুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy